১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পটভূমি ও গ্রেফতার – এইচ. টি. ইমাম

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পটভূমি ও গ্রেফতার : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব দেন | বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পরমুহূর্ত থেকে। বিগত ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তৎকালীন ইপিআর-এর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ডিকোডেড মেসেজে পূর্ববঙ্গের সর্বত্র প্রচারের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী প্রেরণ করেছিলেন। এই মেসেজ তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসকসহ বিশ্বের আরো কয়েকটি দেশ রেকর্ড করতে সক্ষম হয়েছিল। এসব রাষ্ট্রের মধ্যে ভারতের প্রতিরক্ষা বিভাগ এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য।

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত প্রকাশিত তথ্য জনসমক্ষে আসায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে সংযোজিত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতা ঘোষণাকে বলবৎ করার জন্য প্রয়োজন পড়ে একটি রাজনৈতিক কাঠামো, কেন্দ্রীয় পরিচালনা কাঠামো। বঙ্গবন্ধুর অনুসারীগণ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সামরিক অভিযান ব্যাপকতর করলে মুক্তিযোদ্ধাগণ সীমান্তের প্রতিবেশী বন্ধুদেশ ভারতে আশ্রয় নেন। কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে আওয়ামী লীগের এমএনএ এবং এমপিএ-দের সংগঠিত করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধি তাজউদ্দীন আহমদ এক সমবেশের আয়োজন করেন।

এই সমাবেশ একটি নিয়মতান্ত্রিক অধিবেশনে রূপ লাভ করে। অধিবিশেনে উপস্থিত এমএনএ এবং এমপিএ-গণ সর্বসম্মতিক্রমে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রচারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ ১০ এপ্রিল (১৯৭১) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণাও প্রদান করেন। ঘোষিত সরকারের মন্ত্রিসভায় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে খোন্দকার মোশতাক আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ. এইচ. এম কামারুজ্জামানকে মন্ত্রী নিযুক্ত করে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।

তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার ভবেরপাড়ার (বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে ১৭ এপ্রিল শনিবার এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের দেশি-বিদেশি ১২৭ জন সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানি সামরিক সরকারের হাতে বন্দী।

বাঙালি জাতিকে দমনের চেষ্টা ব্যর্থ :

বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেন যে, আজ (১৭ এপ্রিল) থেকে বৈদ্যনাথতলার নাম মুজিবনগর এবং এই অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগর থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধ পরিচালিত হবে।

অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগরে প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যগণকে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচয় করানো এবং আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র পাঠের মাত্র দুই ঘণ্টা পরেই পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনী বিমান থেকে মুজিবনগরে বোমাবর্ষণ করে। ঐদিন থেকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সর্বাত্মক যুদ্ধ নতুন পর্যায়ে উন্নীত হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত প্রথম বাংলাদেশ সরকারকে দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানি সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পটভূমি :

উনিশ শ’ একাত্তর সালের পঁচিশে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার এই পরিকল্পনার কথা বঙ্গবন্ধু আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রামকে নেতৃত্বহীন করতে ইয়াহিয়া খান তার সামরিক উপদেষ্টাদের সাথে গোপন বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেন। মেজর জেনারেল খাদিম ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী “অপারেশন সার্চলাইট” পরিকল্পনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নকালে যে নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হবে তাদের নামের তালিকাও তৈরি করা হয়েছিল।

এই তালিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, জেনারেল ওসমানী, সিরাজুল আলম খান, আতাউর রহমান খান, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, মতিয়া চৌধুরীর নাম ছিল। গ্রেফতারের কর্মসূচিসহ অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা অনুমোদন করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকার তার অফিস থেকে জেনারেল ইয়াহিয়ার বিমানে ওঠার দৃশ্য দেখে ফেলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে এ সম্বন্ধে অবহিত করেন।

ছাব্বিশে মার্চ রাত দেড়টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার সম্পর্কে দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, লেখক, বিশ্লেষক, গবেষকগণের কিছু বিবরণ প্রসঙ্গক্রমে এখানে তুলে ধরা হলো।

বঙ্গবন্ধুর জামাতা প্রয়াত ড. ওয়াজেদ মিয়া বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার আগের কিছু স্মৃতি তার লেখা গ্রন্থ “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ”-এ বর্ণনা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর এবং আগের কিছু স্মৃতি তার রচিত “অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জ্বল বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার আমি” নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। স্বয়ং তার গ্রেফতার প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি মুক্ত বাংলাদেশে ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে যেসব কথা বলেছিলেন তা প্রণিধানযোগ্য। এই সাক্ষাৎকার নিউ ইয়র্কের টিভি চ্যানেলে প্রদর্শিত ও প্রচারিত হয়েছিল। সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন :

…That evening, my house was sorrounded by commandos they wanted to kill me if I come out of the house, giving names my own people and saying that Mujib Rahman has been killed by the extremists of Bangladesh. Then they decided to take action telling the world that we are negotiating with Mujibur Rahman and that Yahya Khan has no alternative but to take action against that. That was their first idea. I know they are brutes, uncivilized. They will kill my whole people. They will make a massacre. thought it better I die and at least save my people who love me so much.

(…সেই সন্ধ্যায় যেসব কমান্ডো আমার বাসগৃহ ঘিরে রেখেছিল তাদের প্রত্যাশা ছিল এই যে, আমি বাসার বাইরে আসি এবং তারা আমাকে হত্যা করবে, আমার নিজের লোকজনের নাম দিয়ে বলবে যে মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের চরমপন্থীরাই হত্যা করেছে। তখন তারা বিশ্ববাসীকে এটা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে আমরা মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করছিলাম কিন্তু ইয়াহিয়া খানের এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল এটাই তাদের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল। আমি জানি তারা নিষ্ঠুর, অসভ্য। তারা আমার সব মানুষকে মেরে ফেলবে। তারা তছনছ করে ফেলবে। আমি ভাবলাম আমার মরণই ভাল, তাতে অন্তত আমার লোকজন যারা আমাকে খুবই ভালবাসে তারা রেহাই পাবে।) (শীলেন্দ্র কুমার সিংহ ও অন্যান্য সম্পাদিত “বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড” নামক গ্রন্থের ৬১৫ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।)

পাকিস্তান সামরিক শাসকগণ বঙ্গবন্ধুকে যেকোনোভাবে তার আন্দোলন-সংগ্রামকে নস্যাৎ করতে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। এ আশঙ্কা বঙ্গবন্ধুর মনে দৃঢ়মূল হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু নিজেই তার গ্রেফতার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লছিলেন, সে রাতে তাকে যদি পাকবাহিনীর সদস্যরা গ্রেফতার করতে না পারত, তবে লোক-ক্ষয়ের ভয়াবহতা সীমাহীন পর্যায়ে পৌছুতো। ইয়াহিয়া-টিক্কার উন্মত্ত সেনাসদস্যরা সাধারণ মানুষের বাসা-বাড়ি ঘরে প্রবেশ করে বঙ্গবন্ধুকে খুঁজত। এই তল্লাশি চালানোকালে স্বাভাবিকভাবেই বঙ্গবন্ধুকে না তারা নিরীহ মানুষজনকে নির্বিচারে হত্যা করত। এতে গণহত্যা আরো ব্যাপকতর হতো।

বঙ্গবন্ধু সব বুঝে, নিজ বাড়িতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার জামাতা ড. ওয়াজেদ মিয়াকে ডেকে হাসিনা, রেহানা জলীকে নিয়ে তাদের ফ্ল্যাটে যেতে বলেছিলেন। ওয়াজেদ বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, ‘তিনি কোথায় যাবেন এবং কামাল, জামালকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাবো কি না’। উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমার এখন অন্যত্র যাওয়ার কোনো উপায় নেই। তাই তারা আমাকে মারতে চাইলে এ বাসাতেই মারতে হবে। কামাল অন্যত্র চলে গেছে। জামাল ওর মাকে ছেড়ে থাকতে পারে না, সে আমাদের সঙ্গে থাকবে। এসব কথা ড. ওয়াজেদ মিয়া তার রচিত “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ” নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন।

এর আগে শেখ মুজিবের সহকর্মী ও অনুরাগীরা তাঁকে ঢাকা ছেড়ে যেতে সম্মত করাতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তিনি রাজি হননি। তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে যারা যেতে চান তাদের চলে যাওয়াতে তিনি সম্মতি দিয়েছিলেন। সামরিক অভিযান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন ছদ্মবেশে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন।

পাকিস্তানের করাচি থেকে প্রকাশিত ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকার রিপোর্টার অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস ২৫ মার্চের কয়েক সপ্তাহ পর বঙ্গবন্ধুর পরিত্যক্ত বাসা পরিদর্শন করেছিলেন। ম্যাসকারেনহাস ২৫ মার্চ রাতের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। তিনি তার বিবরণীতে এক রিকশাচালকের কথা উল্লেখ করেছেন। এই রিকশাচালক বঙ্গবন্ধুর জন্য এক জরুরি বার্তা বহন করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে রিকশা চালিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাসায় পৌছেন।

সংক্ষিপ্ত বার্তায় বাংলায় লেখা ছিল, ‘আজ রাতে আপনার বাড়ি আক্রান্ত হবে।’ আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দকে ডেকে বঙ্গবন্ধু বার্তার কথা জানিয়েছিলেন। নিজে আত্মগোপন না করা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- আমার জনগণকে রক্ষা করবার ছিল। আমি যদি সেখানে না থাকতাম তবে আমার খোঁজে ইয়াহিয়া খান গোটা শহর জ্বালিয়ে দিত। ম্যাসকারেনহাস উক্ত রিকশাচালককে ছদ্মবেশে কোনো বাঙালি সৈনিক হিসেবে অনুমান করেছিলেন।

বাঙালি জাতির অকুতোভয় নেতা যার দল আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করেছে তিনি কখনো পালিয়ে যেতে কিংবা আত্মগোপন করতে পারেন না। বঙ্গবন্ধু তার কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। কারণ, তার যা করণীয় তিনি তা করেছিলেন। পূর্ববঙ্গের বাঙালি জনগণকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন। তিনি যেকোনো পরিস্থিতির জন্য তখন প্রস্তুত ছিলেন। চার দিকে প্রচণ্ড গোলাগুলির অর্থ বঙ্গবন্ধুর বুঝতে দেরি হয়নি। তিনিও রাত দেড়টার আগে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তার সেই ছোট্ট স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কিত বার্তা দেশের সর্বত্র পৌছানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। বার্তাটি ছিল— ‘মধ্যরাতে পাকবাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানার ইপিআর হেড কোয়ার্টার আক্রমণ করেছে। এদের প্রতিহত করার শক্তি সঞ্চয় করুন এবং প্রস্তুত হোন স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য।

পাকিস্তানের লাহোর থেকে ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত আহমেদ সালিমের “ব্লাড বিট্‌ ট্র্যাক” নামক গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার হওয়ার উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তের কিছু বর্ণনা এরূপ : এক অতীর গুরুতর দায়িত্ব পেয়েছিলেন পাকিস্তানি মেজর বিলাল রাত দেড়টার সময় এটা তিনি সমাধা করতে চেয়েছিলেন। তার অধীনে ছিল একটা ট্যাঙ্ক, একটা আরমারড পারসনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) এবং কয়েকটি ট্রাকভর্তি জওয়ান। তিনি তাদের নিয়ে যাচ্ছিলেন ধানমন্ডির দিকে। রাস্তায় অনেক ব্যারিকেড ও বাধা অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাড়ির সামনে এসে তারা সবাই থামল। বাড়িটি তাক করে প্রায় সব জওয়ানই কিছুক্ষণ গুলি চালাল।

আহমেদ সালিম আরো লিখেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান তখন শয্যায় ছিলেন। গোলাগুলির আওয়াজ শুনে তিনি উঠে স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে ঠেলে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিলেন। প্রায় এক শ’ সৈন্য বাড়িটি ঘিরে রেখেছিল এবং এমন এক অসমশক্তি-সমাবেশ দেখে যেকোনো সাধারণ মানুষও ভাববে যে, সেনাবাহিনী যেন কোনো অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত দুর্গ আক্রমণ করতে প্রস্তুতি নিয়েছে। বাড়ির চার দিক ঘিরে ফেলে জওয়ানরা অনবরত আকাশের দিকে গুলি ছুড়ছিল।

ব্যাপক গোলাগুলির মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেগম ফজিলাতুননেসা মুজিবের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে ঘরের বাইরে এসে পাকিস্তানি জওয়ানদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমরা এখন গোলাগুলি বন্ধ করতে পারো। আমি এখানে আছি। তোমরা কেন গুলি ছুড়ছ? এরপর তারা চারদিক থেকে আমাকে আক্রমণ করতে এগিয়ে আসতে থাকে। তাদের মধ্যে উপস্থিত একজন জওয়ান তখন আমাকে জড়িয়ে ধরলো এবং বললো একে হত্যা করো না।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জীবিত আটক করার নির্দেশ ছিল। জীবিত আটক করার এই নির্দেশ দেওয়া হয় ঢাকার শেরে বাংলানগরে অবস্থিত পাকিস্তান সামরিক হেড কোয়াটার্স থেকে। একজন সামরিক অফিসার বঙ্গবন্ধুর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে, “আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে স্যার।”

ঢাকায় গ্রেফতারের তিন দিন পর অর্থাৎ ২৯ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে প্লেনে পশ্চিম পাকিস্তানে নেওয়া হয়। পাকিস্তান সামরিক জান্তার কাছে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা বন্দী। এ জন্য বঙ্গবন্ধুকে অজ্ঞাত স্থানে রাখা হয়েছিল। তাকে কখনো এক স্থানে রাখা হতো না। প্রথমে ঢাকা সামরিক বাহিনীর এলাকায় অবস্থিত আদমজি ক্যান্ট, স্কুলে এবং পরে ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসে আটক করে রাখা হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রেরণের বিষয়েও তারা কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করে। সামরিক জান্তার আতঙ্ক ছিল যে, বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী প্লেনকে হয়তো কোনো বিদেশি রাষ্ট্র আকাশ পথে যাওয়ার সময় ধাওয়া করতে পারে।

পাকিস্তনে বঙ্গবন্ধুকে লায়ালপুর জেলে অপরিসর একটি কুঠুরিতে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। বাঙালি জাতির সঙ্গে সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী ও গণতান্ত্রিক মানুষজন জানত যে, পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ নয় মাস নিঃসঙ্গ ছিলেন। তৎকালে সারা পৃথিবীর মানুষ তার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পৃথিবীর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন জোগায়।

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পটভূমি ও গ্রেফতার - এইচ. টি. ইমাম
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পটভূমি ও গ্রেফতার – এইচ. টি. ইমাম

লেখক:

এইচ. টি. ইমাম

বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-১৯৫৭ বই এর তৃতিয় অধ্যায় [পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ] থেকে উধৃত।

[ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পটভূমি ও গ্রেফতার ]

বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে এইচটি ইমাম আরও লিখেছেন:

 

১। ম্যাসকারেনহাস রচিত ১৯৯৫ সালের সংস্করণ ‘দ্য রেপ অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থের ১১২ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।

২। আহমেদ সালিম কৃত এবং মফিদুল হক অনুদিত ‘পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবের বন্দিজীবন’ নামক গ্রন্থের ২৭-২৮ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।

৩। নিউ ইয়র্ক থেকে রবার্ট পেইন রচিত ম্যাসাকর নামক গ্রন্থের ৯০-৯১ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।

৪। ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু এ কথাগুলো বলেছিলেন। ডেভিড ফ্রস্টের এই সাক্ষাৎকার পাকিস্তানের করাচি থেকে প্রকাশিত ‘আউটলুক ম্যাগাজিন’ নামক পত্রিকায় ১৯৭৩ সালের ২২ এপ্রিল প্রকাশিত হয়।

৫। নয়াদিল্লি থেকে ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত ম্যাসকারেনহাস রচিত ‘দ্য রেপ অব বাংলাদেশ’ নামক গ্রন্থের ১১২ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের বিস্তৃত বর্ণনা দেওয়া আছে।

Leave a Comment