পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার লক্ষ্যে প্রহসনমূলক বিচার ও প্রত্যাবর্তনের পটভূমি : ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান টেলিভিশনে ১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট ঘোষণা করেন যে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও অন্যান্য অপরাধের জন্য বিশেষ সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার করা হবে। বিচার প্রহসনের এই ঘোষণার বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে তীব্র প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী চব্বিশটি দেশের কাছে শেখ মুজিবের জীবন রক্ষার্থে আবেদন জানান। আমেরিকাও উদ্বেগ প্রকাশ করে পাকিস্তান সরকারকে জানায়, গোপন বিচার অনুষ্ঠান করা হলে পূর্ববঙ্গের সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা অবশিষ্ট থাকবে না। জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট এই বিচার অনুষ্ঠিত হলে তার প্রতিক্রিয়া পাকিস্তানের বাইরেও বিস্তৃত হবে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সব সতর্কতামূলক পরামর্শ উপেক্ষা করে লায়ালপুরের কারাগারে বিচারানুষ্ঠানের আয়োজন করেন। প্রহসনমূলক এই বিচারে আদালত মনোনীত আইনজীবীর সহায়তা নিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসম্মতি জানিয়েছিলেন। আইনজীবীকে বলেছিলেন, ‘…আমি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। আমাকে অথবা আমার জনগণকে বিচার করার কোনো অধিকার এদের নেই। আইনের দৃষ্টিকোণ থেকেও কোনো বৈধতা নেই এ আদালতের।”[৯]
প্রহসনমূলক বিচারকাজ সপ্তাহকাল চলেছিল। আদালতের কার্যক্রমের বিবরণী শেখ মুজিবকে দেওয়া হলে তিনি তার ওপর লিখে দেন, “সব মিথ্যে।”১০
বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের পক্ষ থেকেও ওঠে। পাকিস্তানের লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী, ছাত্রনেতা, আইনজীবী, অধ্যাপকবৃন্দ শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বরাবর আবেদন জানিয়েছিলেন। নিজ দেশের জনগণের দাবিও ইয়াহিয়া খান উপেক্ষা করেন। সামরিক আদালত ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর শেখ মুজিবকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করে। জুলফিকার আলী ভুট্টো আবার ইয়াহিয়া খানের সাথে দেখা করে শেখ মুজিবকে ফাঁসি না দেওয়ার পরামর্শ দেন। এবার ইয়াহিয়া ভুট্টোর পরামর্শ অনুযায়ী শেখ মুজিবের ফাঁসির আদেশ স্থগিত রাখেন।
বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পরিচালিত সামরিক আদালতে বিচারানুষ্ঠান এবং মৃত্যুদণ্ড প্রদানের খবরও পৌঁছে যায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাছে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ কমান্ডে মিত্রবাহিনী গঠনের প্রক্রিয়া আগেই সম্পন্ন হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ডাদেশ স্থগিত রেখে পাকিস্তান হঠাৎ ভারতীয় ভূখণ্ড আক্রমণ করে বসে। ভারতের সঙ্গে ইতঃপূর্বে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি সম্পাদিত হওয়ায় ভারত সরাসরি পাকিস্তানের আক্রমণ প্রতিহত করতে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়।
অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দারুণভাবে পর্যুদস্ত হয়। উল্লেখ্য, পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী আর মিত্র বাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানি সমর নায়ক জেনারেল এ. এ. কে. নিয়াজী ১৫ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের প্রস্তাব করেন এবং পরদিন অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর দেন। পূর্বাঞ্চলের রণাঙ্গনে বিপর্যয় সত্ত্বেও যুদ্ধ অব্যাহত রাখার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেন ইয়াহিয়া খান।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জেনারেল নিয়াজী যখন আত্মসমর্পণ করছিলেন তখনো বঙ্গবন্ধু কারাকুঠুরিতে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বিশেষ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু তার আগেই ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে হলো। এই সংবাদে প্রতাপশালী জেনারেল ইয়াহিয়া বেসামাল হয়ে পড়েন। তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব দেন। এই ইচ্ছার কথা জানিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভুট্টোকে বলেছিলেন, ‘মুজিবকে শুরুতেই না মেরে তিনি মহা ভুল করেছেন।
এখন আপনাকে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে পেছনের তারিখ দিয়ে নির্দেশ জারি করে মুজিবকে মেরে ফেলার সুযোগ আমাকে দিন। ১১ কিন্তু ভুট্টো এ প্রস্তাবে সম্মত হননি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী যৌথ কমান্ডের মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কার্যত গৃহবন্দী হন।
বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের ২১ দিন পর ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু যখন ঢাকায় ফিরলেন তখন তিনি ছিলেন আনন্দিত ও পরিশ্রান্ত। কমেট প্লেন থেকে নামার সময় তার চোখ বেয়ে ঝরছিল আনন্দাশ্রু। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগারে তার নয় মাসের অগ্নিপরীক্ষা এবং চূড়ান্তপর্যায়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো কর্তৃক মুক্তি দানের ঘটনাবলির বিবরণ দিয়ে সাপ্তাহিক নিউজউইক-এ এক সাক্ষাৎকার প্রদান করেছিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেও দেশের বিশেষত বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর জানা ছিল না।
ইয়াহিয়ার বিদায়ের পর বঙ্গবন্ধু এবার জুলফিকার আলী ভুট্টোর বন্দিতে পরিণত হলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনো জানতেন না যে, তিনি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রধান। হঠাৎ করেই ২৬ ডিসেম্বর একটি সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টার এসে বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিন্ডির বাইরে এক বাংলোয় নিয়ে যায়। আর্মি কমান্ডোদের প্রহরায় ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে সেখানেই রাখা হয়। পাকিস্তানের নবনিযুক্ত মন্ত্রী আজিজ আহমদ বঙ্গবন্ধু এবং ড. কামাল হোসেনকে জানান যে, রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি সম্বন্ধে জনমত যাচাই করবেন।
ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল এবং সে দায়িত্ব পাকিস্তান কর্তৃপক্ষেরই ছিল। আজিজ আহমদ বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, দু-এক দিনের মধ্যে আপনার মুক্তির বিষয়ে আমাদের প্রেসিডেন্টের প্রচেষ্টার পরিচয় পাবেন। বিগত ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি পাকিস্তান টেলিভিশনের সান্ধ্যকালীন সংবাদে করাচির জনসভায় বঙ্গবন্ধুর মুক্তি সম্পর্কিত ভুট্টোর জনমত যাচাইয়ের দৃশ্য প্রচারিত হয়। বঙ্গবন্ধু সিহালা অতিথিশালায় বসে তা দেখেছিলেন।
অবশেষে প্রতীক্ষিত মুক্তির দিন এলো। পিন্ডিতে প্রেসিডেন্টের অতিথিশালায় বঙ্গবন্ধুকে জানুয়ারির ৭ তারিখে প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই নৈশভোজে ড. কামাল হোসেনও আমন্ত্রিত ছিলেন। বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে অমানবিক কর্মকাণ্ডের জন্য পাকিস্তান সামরিক শাসকবৃন্দের ওপর সারা বিশ্বের চাপে জুলফিকার আলী ভুট্টো ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেন। ওই দিন মধ্যরাতের পরপরই বিশেষ বিমানে বঙ্গবন্ধু ও ড. কামাল হোসেন পিডি ত্যাগ করেন। ড. কামাল হোসেনের স্ত্রী ও কন্যাও তাদের সঙ্গে ছিলেন।
পিডি ত্যাগের আগে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে অনেক অনুনয়-বিনয় করে যুক্ত পাকিস্তানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘… আমাদের দুটি পৃথক জাতি হওয়া চলবে না শেখ সাহেব। যেমন করেই হোক আমাদের সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। তবে আগের মতো নয়, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান বলে চেনা যায়, এমন একটি দেশ হিসেবে। আর যাই হোক, আমাদের ধর্ম এক, উদ্দেশ্যও এক। দেখুন শেখ সাহেব সব কিছুর পরও আমরা এখনও এক জাতি, সেই সত্যের মুখোমুখি আমরা হয়েছি।
আমাকে বিশ্বাস করুন, আমরা এই বন্ধন ছিন্ন করতে পারি না। এ কথা আমাদের উভয়ের ভাবা উচিত। অবশ্য এ কথা পশ্চিম পাকিস্তানে বসে ভাবতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমরা একটি নিরপেক্ষ দেশে আলোচনার জন্য মিলিত হতে পারি। উদাহরণত ইরানের নাম উল্লেখ করতে পারি। প্রকৃতপক্ষে শাহিনশাহ আশা করেন, আমরা ইচ্ছা করলে তেহরানে আলোচনায় বসতে পারি।…ইরান যদি আপনার পছন্দ না হয়, তাহলে আমরা সুইজারল্যান্ডে মিলিত হতে পারি- শুধু আমরা দুজন।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাতে সাড়া দেননি।
তবে বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে বলেছিলেন, ‘আমি এখনও আপনার বন্দি। এমনকি আমার স্ত্রীকে আমি টেলিফোন করার অধিকারী নই। … আমার মন্ত্রীদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা না করে কিভাবে, আমার সামনে আপনি যে কাগজের টুকরো রেখেছেন, তাতে আমি স্বাক্ষর দিতে পারি? আপনার ইচ্ছা পূরণের জন্য আপনি আমাকে জোর করে রাজি করাতে চেষ্টা করছেন। আপনি আমাকে গুলি করতে পারেন, কিন্তু ঢাকায় গিয়ে আমার মন্ত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ না হওয়া পর্যন্ত আমি কোনো কাগজে স্বাক্ষর দেবো না।’
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ব্রিটিশ লেখক রবার্ট পেইন বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের ভবিষ্যতে সম্পর্ক থাকবে কি না সে সম্পর্কে দ্য টরচারড অ্যান্ড দ্য ড্যাড নামক গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু ও ভুট্টোর কথোপকথনের বিবরণ বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। ভুট্টোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কথাবার্তা এভাবেই শেষ হয়। বঙ্গবন্ধুকে বিদায় জানালেন ভুট্টো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের বাইরে বোয়িং ৭০৭-এ লন্ডন নিয়ে আসেন এয়ার মার্শাল জাফর চৌধুরী। তিনি তার লেখা মোজাইক অব মেমোরি নামক গ্রন্থে বঙ্গবন্ধর লন্ডন গমন সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।
লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধু নয়াদিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি (১৯৭২) বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। ঢাকায় ফিরেই রমনা রেসকোর্স ময়দানের বক্তৃতায় তিনি স্পষ্টভাবে পাকিস্তানের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা সুখে থাকুন। আপনাদের সঙ্গে আর না। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে।’
পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যাবর্তনের পটভূমি এটাই।

লেখক:
এইচ. টি. ইমাম
বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-১৯৫৭ বই এর তৃতিয় অধ্যায় [পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ] থেকে উধৃত
[ পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু ]
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এইচটি ইমাম আরও লিখেছেন:
রেফারেন্স:
৯। ঢাকা থেকে ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত ওবায়দুল হক রচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এ লিডার উইথ এ ডিফারেন্স শীর্ষক গ্রন্থের ১১৬, ১১৭ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
১০। আহমেদ সালিম রচিত এবং মফিদুল হক অনূদিত “পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবের বন্দিজীবন“
১১। পাকিস্তানের করাচি থেকে প্রকাশিত আউটলুক ম্যাগ্যাজিনের ১৯৭৩ সালের ২২ এপ্রিল সংখ্যা দ্রষ্টব্য।