বাঙালির মুক্তির দাবিতে অনড় বঙ্গবন্ধুর চূড়ান্ত কর্মসূচির দিনগুলি
১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে সরাসরি ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬০ আসন জিতে নিরঙ্কুশভাবে সরকার গঠনের অধিকার অর্জন করে আওয়ামী লীগ। বাঙালির মুক্তির সনদ তথা ৬ দফার প্রতি আপামর বাঙালির সমর্থনের ম্যান্ডেট ছিল নৌকায় মার্কার এই গণজোয়ার। কিন্তু পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং সামরিক স্বৈরাচার জেনারেল ইয়াহিয়া খান বাঙালির এই জয়কে মেনে নিতে পারলো না। ফলে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বানচালের পরিকল্পনা করে তারা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৩ তারিখের অধিবেশনে যোগদানে অস্বীকৃতি জানায় জুলফিকার আলী ভুট্টো। ফলে ১ মার্চ ঘোষণা দিয়ে অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে তারা। এমনকি ২ মার্চের সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্যদের নির্বাচনের বিরুদ্ধেও হুমকি দেয় ভুট্টো। যেকারণে পশ্চিম পাকিস্তানের মহিলা আসনের নির্বাচনও স্থগিত করে ইয়াহিয়া খান।
মূলত, বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক বিজয়কে ভূমিস্যাৎ করতে- ১৯৭১ সালের শুরু থেকেই- রাওয়ালপিণ্ডিতে ভুট্টোর কমলা-বাগানে বসে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা রচনা করে ভুটো-ইয়াহিয়া জুটি। যার ফলশ্রুতিতে, একদিকে ভুট্টো উস্কানিমূলক বক্তব্য দিতে শুরু করে। অন্যদিকে তা বাস্তবায়নের নামে বাঙালি জাতির গণতান্ত্রিক অধিকার লুট করার জন্য একের পর এক উদ্যোগ নিতে থাকে জান্তা-প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান। এমনকি এরকম একটি সময়ে পাকিস্তান জামায়াতের প্রধান সৈয়দ আবুল আলা মওদুদীও বাঙালি জাতিকে নিয়ে নেতিবাচক বক্তব্য দিয়ে উস্কানি দিতে শুরু করে।
পশ্চিম পাকিস্তানি উগ্রবাদী গোষ্ঠী ও স্বৈরাচারদের এসব ষড়যন্ত্রের জবাবে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘৬-দফার পক্ষে বাংলাদেশের নির্বাচনি রায়কে সচেতনভাবে বানচাল করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে তারা।’ তিনি আরো বলেন, ‘ছয় দফার ব্যাপারে কোনো আপস নাই। জনগণের ইচ্ছার প্রতি সবার শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত।’ এমনকি ৬-দফা পরিবর্তনের ব্যাপারে ভুট্টোর দাবির জবাবে বঙ্গবন্ধু আরো বলেন, ‘ছয়-দফা এখন জনগণের সম্পত্তি। উহা পরিবর্তন বা সংশোধনের কোনো অধিকার কারো নাই, এমনকি আমারো নাই। ছয়দফা এবং এগারো দফার ভিত্তিতেই শাসনতন্ত্র রচিত হবে। কেউ ইহা রোধ করিতে পারিবে না।’
প্রসঙ্গত; ১ মার্চ ১৯৭১ দুপুরের এক ঘোষণায় যখন ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে পশ্চিম পাকিস্তানিরা, ঠিক তার পরপরই ফুঁসে ওঠে পুরো বাঙালি জাতি। সেদিন বিকালেই পল্টনের বৈঠক থেকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। প্রাথমিকভাবে ২ ও ৩ মার্চ হরতাল ঘোষণা করেন তিনি। একই দিন, পৃথক কর্মসূচিতে বঙ্গবন্ধু বলেন যে- তার দল সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে বিশ্বাসী, যাতে সমাজের সর্বোস্তরের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়। তবে এটি হবে পুরোপুরি নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়।
বাঙালির মুক্তির দাবিতে অনড় বঙ্গবন্ধুর চূড়ান্ত কর্মসূচির দিনগুলি
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্যদের নিয়ে, ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আকস্মিকভাবে স্থগিত করা হয়। ১ মার্চ দুপুরে স্বৈরাচার ইয়াহিয়া খানের পক্ষ থেকে বেতারে এই ঘোষণা সম্প্রচারের পর উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকাসহ পুরো বাংলাদেশ। তাৎক্ষণিকভাবে পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগের সংক্ষিপ্ত সভা শেষে- এক সাংবাদিক সম্মেলনে- ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারা দেশে হরতালের ঘোষণা দেন নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একইসঙ্গে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার জন্য ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভার ঘোষণাও দেন তিনি।
পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের সেন্টিমেন্টের জন্য পরিষদ অধিবেশন স্থগিত রাখা হইয়াছে। আমরা উহা নীরবে সহ্য করিতে পারি না। ইহার দ্বারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রায় ব্যর্থ হইয়াছে। পরিষদ অধিবেশনের জন্য বাংলাদেশের সকল সদস্যই ঢাকায় ছিলেন।’ এসময় জনগণকে সবরকমের ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু।
সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার দোকান-পাট, অফিস-আদালত, সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তায় নেমে আসেন ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক-পেশাজীবী-আইনজীবীসহ সর্বশ্রেণির মানুষ। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো বাংলা। এদিকে, বাঙালি জাতির স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে দমানোর জন্য ১১০ নং সামরিক আদেশ জারি করে আন্দোলন সংক্রান্ত সংবাদ ও ছবি প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী।
১ মার্চ সন্ধ্যা থেকে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাসভবনে বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাৎ করে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা নিতে শুরু করেন। যার ধারাবাহিকতায় মার্চ মাসজুড়ে পাকিস্তানিদের প্রতি তীব্র অসহযোগ আন্দোলন গড়ে ওঠে বাংলাদেশে।
এদিকে, ভুট্টোর চালে ২ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানের সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্যদের নির্বাচন স্থগিত হলেও, বাংলাদেশের এই নির্বাচন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে এবং ৭ জন নারী সদস্য নির্বাচিত হন। সারা বাংলাদেশ যখন অধিকার আদায়ের জন্য উত্তাল হয়ে ওঠে, ঠিক তেমন পরিস্থিতিতে- বাঙালি জাতির প্রতি ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেনারেল ইয়াহিয়াকে অভিনন্দন জানায় পাকিস্তান মুসলীম লীগের প্রধান কাইয়ুম খান।
ইয়াহিয়া ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে- বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে- ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রলীগ এবং ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে শ্রমিক লীগের বিক্ষোভ ও জনসভা পালিত হয়। এই দুই কর্মসূচিতেই স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ছাত্রনেতারা।
পল্টনের সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। ওই সমাবেশেই প্রকাশ্যেই নির্ধারণ করা হয় মুক্তিযুদ্ধের কিছু স্লোগান। যেমন: ‘স্বাধীন কর স্বাধীন কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘স্বাধীন বাংলার মহান নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’, ‘গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়, মুক্তিবাহিনী গঠন কর’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। স্বাধীনতার ইশতেহার প্রস্তাবনার পরপরই তুমুল করতালি ও ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পল্টন ও পার্শ্ববর্তী এলাকা। সেই সময় ওই জনাকীর্ণ সভা থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
(১৯৭১ সালে ৩ মার্চের পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদগুলো থেকে এসব তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে)
#March1971 #Bangladesh #Independence #MonthOfIndependence #Bangabandhu #SheikhMujib #AwamiLeague #বঙ্গবন্ধু #শেখমুজিব #অগ্নিঝরা_মার্চ
আরও পড়ুন: