বঙ্গবন্ধুর সরকার – বৈদেশিক বাণিজ্য এবং বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য : দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক বাণিজ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। বৈদেশিক বাণিজ্যে আমদানি ও রপ্তানি উভয়ই অন্তর্ভুক্ত হয়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রপ্তানির গুরুত্ব বেশি। যে দেশ যত বেশি পণ্য এবং সেবা অন্য দেশে রপ্তানি করতে সক্ষম হবে সে দেশ অর্থনৈতিকভাবে তত বেশি উন্নত হবে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে দেশের অধিকাংশ কলকারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শিল্পের উৎপাদন অনেক কমে গিয়েছিল।
বৈদেশিক বাণিজ্য এবং বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য
দেশে দুটি বন্দরই ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেই অবস্থা থেকে সমস্ত কলকারখানা, বন্দরসমূহের পুনর্গঠনের কাজ সমাপ্ত করে সরকারকে রপ্তানি প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়েছিল। এত প্রতিকূল অবস্থার মাঝেও ১৯৭২-৭৩ সালে সরকার ৩২১.৬৫ কোটি টাকার পণ্য ও সেবা রপ্তানি করতে সক্ষম হয়েছিল। এই রপ্তানির পরিমাণ ডলার হিসাবে ১৯৬৯-৭০ সালের তুলনায় কিছুটা কম হলেও টাকার হিসাবে ১৮.৭০% বেশি। যা নিঃসন্দেহে এক অকল্পনীয় সফলতা। নিচে ১৯৭২-৭৩ থেকে ১৯৭৫-৭৬ অর্থ বছরের রপ্তানির তথ্য উপস্থাপন করা হলো :
বছর — রপ্তানি (কোটি মার্কিন ডলার) — রপ্তানি (কোটি টাকা) — বৃদ্ধির হার (%)
১৯৭২-৭৩ — ৪৩.৮৮ — ৩২১.৬৫ —
১৯৭৩-৭৪ — ৪১.১৪ — ৩২৭.৯২ — (৬.২৫%)
১৯৭৪-৭৫ — ৪৯.৭৫ — ৪৪১.৮১ — ২০.৯৩%
১৯৭৫-৭৬ — ৩৬.১২ — ৫৪৩.৬৮ — ( ২৭.৪০% )
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রপ্তানির গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধু সরকার দেশের রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। কোন দেশের সাথে বাণিজ্যের জন্য উক্ত দেশের স্বীকৃতি প্রয়োজন । বঙ্গবন্ধু সরকার সাড়ে তিন বছরে বিশ্বের ১১৬টি দেশ থেকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি গ্রহণ করেছিলেন। অন্য দেশের স্বীকৃতি আদায় করা কত কঠিন কাজ ছিল তা সর্বপ্রথম স্বীকৃতিদানকারী ভারতের নিকট থেকে স্বীকৃতি আদায়ের প্রক্রিয়াটি পর্যালোচনা করলেই বোঝা সম্ভব।
২৪ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকৃতির জন্য ভারত সরকারের কাছে প্রথম আবেদন করেন। ১৫ অক্টোবর দ্বিতীয় আবেদন জানানো হয়। এবং উল্লেখ করা হয় ভারতের স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পথ সুগম করবে।
২৩ নভেম্বর লেখা তৃতীয় চিঠিটি যার মাধ্যমে অনতিবিলম্বে স্বীকৃতির জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানানো হয়। ৪ ডিসেম্বর চতুর্থ চিঠি লেখা হলে ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করার সিদ্ধান্ত অবহিত করে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী স্বীকৃতি আদায় করা তুলনামূলকভাবে সহজ হলেও বাংলাদেশকে যথেষ্ট উদ্যোগী হতে হয়েছিল। কারণ পাকিস্তানের অপপ্রচারের কারণে তখনও অনেক রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি বৈরি মনোভাব পোষণ করত।
দেশের রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার বাণিজ্যরত পাশ্চাত্য দেশসমূহে রপ্তানি বৃদ্ধির প্রচেষ্টার সাথে সাথে নতুন রপ্তানি বাজারে প্রবেশের তৎপরতা, প্রতিবেশী দেশসমূহে বিশেষত ভারত, এবং পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের সাথে বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে রপ্তানি উদ্বৃত্ত বিক্রয় সুসাধ্য করা হয়েছিল। এছাড়া পূর্ব ইউরোপীয় কতিপয় দেশ সোভিয়েট ইউনিয়ন ও বার্মার সাথে সম্ভাব্য রপ্তানির মোট শতকরা ১০ ভাগ সমন্বয়ের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট বার্টার বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল ।
বার্টার বাণিজ্য চুক্তিসমূহ চা, নিউজ প্রিন্ট, চামড়া, মসলা ও কাঠ ইত্যাদি রপ্তানির সম্ভাব্যতার দুয়ার খুলে দেয়। রপ্তানি বৃদ্ধির উদ্দেশে সরকার কর্তৃক যথাযথ উৎসাহ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। রপ্তানি সহায়কী প্রদত্ত হওয়ার পর চায়ের রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৯৭৩-৭৪ অর্থ-বছরে চা ও দেশলাইসহ ৯০টি অপেক্ষাকৃত নতুন রপ্তানি দ্রব্যের উপর সহায়কী দেওয়া হয়েছিল।
চায়ের রপ্তানির ক্ষেত্রে এ সহায়কীর পরিমাণ ছিল উৎপাদন ব্যয়ের শতকরা ৩৫ ভাগ, অন্যান্য রপ্তানি দ্রব্যের উপর সহায়কীর পরিমাণ নির্ধারিত হয়েছিল এফওবি মূল্যে শতকরা ৩০ ভাগ। সরকার কর্তৃক বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপের কারণে দুই বছরের ব্যবধানে ১৯৭৪ ৭৫ সালে রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছিল ৪৯.৭৫ কোটি ডলারের সমমূল্যে ৪৪১.৮১ কোটি টাকায়। ১৯৭২-৭৩ সাল থেকে ১৯৭৪-৭৫ সাল পর্যন্ত রপ্তানির গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৫০%।
একথা আজ অনস্বীকার্য বঙ্গবন্ধু সরকার বিভিন্ন দেশের নিকট থেকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি গ্রহণ করে এবং বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করে বৈদেশিক বাণিজ্যের যে দ্বার উন্মোচন করে দিয়ে গেছেন সেই উদ্যোগের ফলেই দেশের রপ্তানির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বৈদেশিক বাণিজ্যের সাথে বৈদেশিক সাহায্যও বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। যদিও সাহায্য দ্বারা কোন জাতির মুক্তি আসে না তথাপি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনের জন্য সাহায্য প্রয়োজন । বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর নীতি ছিল বরাবরই বিপরীতমুখী।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রথম জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনের দ্বিতীয় বৈঠকে বক্তৃতাকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন “আমরা কলোনি ছিলাম। আমরা কোন কিছুতে self sufficient না, আমরা food-এ self sufficient না, আমরা কাপড়ে self sufficient না, আমরা তেলে self sufficient না, আমরা খাবার তেলে self sufficient না, আমাদের raw material কিনতে হবে, ঔষুধে self sufficient না। আমরা কলোনি ছিলাম পাকিস্তানের।
আমাদর সবকিছু produce করতে হবে। সব বিদেশ থেকে আনতে হবে। আমরা কোথায় পাব বৈদেশিক মুদ্রা? ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হবে? না।” বঙ্গবন্ধু আরও বলেন “আমাদের Income করতে হবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। যে মানুষ ভিক্ষা করে তার যেমন ইজ্জত থাকে না, যে জাতি ভিক্ষা করে তাদেরও তেমনি ইজ্জত থাকে না।
ভিক্ষুক জাতির নেতৃত্ব করতে আমি চাই না । আমি চাই আমার দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক এবং সেজন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। শৃঙ্খলা আনতে হবে এবং শৃঙ্খলা দেশের মধ্যে অক্ষুণ্ন রাখতে হবে।” বৈদেশিক সাহায্যের ব্যাপারে এমন নীতি প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে, বাঙালিকে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু এ কথা সত্য যে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তাৎক্ষণিক এমন কোন সম্পদ থাকার কোনো সুযোগ নেই যা দিয়ে পুনর্বাসন, পুনর্নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়।
১৯৭২-৭৩ সালে সরকারের নিজস্ব সম্পদ পরিধি কোন ক্রমেই এই উন্নয়ন, পুনর্নির্মাণ ও পুনর্বাসনের জন্য নির্ধারিত অংক অন্তর্ভুক্ত হবার মতো ছিল না জেনেও বঙ্গবন্ধু সরকার ব্যাপক উন্নয়ন, পুনর্বাসন ও পুনর্নির্মাণের বাজেট প্রণয়ন করেছিলেন এবং বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশসমূহের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং জাপানসহ বিভিন্ন দেশ সফর করেন এবং দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে উন্নয়ন সহযোগী দেশ, সংস্থা এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনাকালে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্য প্রণীত তাঁর অর্থনৈতিক পরিকল্পনা পেশ করে বাংলাদেশকে দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক সহায়তা লাভে সক্ষম হয়েছিলেন।
এরই ফলে ১৯৭২-৭৩ সালের উন্নয়ন, পুনর্নির্মাণ ও পুনর্বাসন বাজেটের পরিমাণ নির্ধারিত হয়েছিল ৫০১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩১৮ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের খাতে। বাকি ১৮২ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা খরচ নির্ধারণ করা হয়েছিল পুনর্নির্মাণ ও পুনর্বাসন খাতে। এখানে উল্লেখ্য যে একটি শূন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার সম্পন্ন দেশের উন্নয়নে শুধু বাজেট প্রণয়নই নয় বাস্তবে তার গিও ছিল যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য।
বিভিন্ন বন্ধু রাষ্ট্র বিশেষ করে ভারত, সোভিয়েট ইউনিয়ন, সুইডেন, কানাডা, যুক্তরাজ্য, পশ্চিম জার্মানি, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ডেনমার্ক ও হল্যান্ড ইত্যাদি দেশ থেকে সাহায্য এবং দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার উন্নয়ন, পুনর্বাসন ও পুনর্নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন প্রায় ৪৬২.৬৬ কোটি টাকার যা মোট বাজেটের ৯২ শতাংশ। অনুরূপভাবে ১৯৭৩-৭৪ সালেও উন্নয়ন, পুনর্নির্মাণ ও পুনর্গঠনে ব্যয় করা হয়েছিল ৪০০ কোটি টাকা যা বাজেটের ৭৬% এবং ১৯৭৪-৭৫ সালেও উক্ত ব্যয় করা হয়েছিল ৪৯৪ কোটি টাকা যা বাজেটের ৯৪%।
একটি কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে বঙ্গবন্ধু সরকার তিন আর্থিক বছরের মধ্যে দুই বছরই সক্ষম হয়েছিলেন ৯২% বা তার অধিক উন্নয়ন বরাদ্দ বাস্তবায়ন করতে যা ছিল অত্যন্ত দুরূহ ও কঠিন কাজ। উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়ন যে কঠিন কাজ তার প্রমাণ পাওয়া যাবে যদি বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের সাথে পরবর্তী সরকার সমূহের এই উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করা যায়।
উক্ত বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় ১৯৭৫-৭৬ সাল থেকে ২০০৮-০৯ সাল পর্যন্ত মোট ৩৪ বছরে ৯২% এর ঊর্ধ্বে উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছিল মাত্র ১১ বছর। বাকি ২৩ বছর এই উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের পরিমাণ ছিল ৯২ শতাংশের নিচে। বৈদেশিক সাহায্যের একটি উপাদান হচ্ছে বৈদেশিক অনুদান। অনুদান প্রাপ্তির পরিমাণ অনেকটাই নির্ভর করে দেশের কল্যাণে এর যথাযথ ব্যবহারের উপর।
যদি এর ব্যবহার যথাযথ না হয়, অনুদানের প্রতিশ্রুতি থাকলেও তা অনেক সময় পাওয়া সম্ভব হয় না। বঙ্গবন্ধু সরকারের সাড়ে তিন বছর সময়ে প্রতিশ্রুত অনুদানের পরিমাণ ছিল ১৪৪.৮৩ কোটি মার্কিন ডলার। প্রতিশ্রুতির সাথে প্রাপ্তির হার ছিল ৯২%। পক্ষান্তরে ১৯৭৫-৭৬ অর্থ-বছর থেকে ২০০৮-০৯ অর্থ বছর পর্যন্ত ৩৪ বছরে প্রতিশ্রুত অনুদানের পরিমাণ ছিল ২৪৩৩.৮০ কোটি মার্কিন ডলার, তার বিপরীতে প্রাপ্ত অনুদানের পরিমাণ ছিল ২০৩৪.২ কোটি মার্কিন ডলার।
প্রতিশ্রুতির সাথে প্রাপ্তির হার ছিল ৮৩.৫৮%। প্রতিশ্রুতির অনুদানের সাথে প্রাপ্তির এই হার এটিই প্রমাণ করে যে, বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় বার্ষিক উন্নয়ন, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কার্যক্রমের বাস্তবায়ন ছিল যথেষ্ট সন্তোষজনক।
আরও পড়ুন: