বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ ও প্রেক্ষাপট – লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক, স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত, পদ্মশ্রী :
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিবুর রহমান দূরদর্শী রাজনীতিক, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধের দিক নির্দেশক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি এবং বিশ্বের সর্বহারা, নির্যাতিত, নিপীড়িত, মেহনতি ও অভুক্ত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। যাঁরা সর্বহারা, নির্যাতিত ও অভুক্ত তাঁদের ভবিষ্যতের চিন্তাই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। মেহনতি মানুষ মাত্রই ছিল তাঁর আপনজন।

বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ একই সূত্রে গাঁথা। আবহমান বাংলার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিবুর রহমান একজন অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। আমাদের জাতীয় জীবনে আজ যে—সকল স্মরণীয় ব্যক্তি বিস্মৃতির উত্তাল তমসাকে বিদীর্ণ করে আপন কীর্তির মহিমায় দ্যুতিমান, বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের অন্যতম।
অন্ধকার, পরাধীনতা, শাসন, শোষণ আর বঞ্চনার শৃঙ্খল ছিন্ন করে তিনি বাঙালি জাতিকে মুক্তির পথের সঠিক সন্ধান দিয়েছেন। তাঁর আপোশহীন সংগ্রাম ও সাহস দেশ, মাটি ও মানুষের জন্য নিখাদ ভালোবাসা আর নেতৃত্বের কারণেই আজ আমরা স্বাধীন।
[ বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ ও প্রেক্ষাপট লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক ]
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর থেকেই বিভিন্ন দাবি আদায়ের লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তানের রাজ‣নতিক অঙ্গন উত্তপ্ত ছিল। সেই সময় থেকেই গণমানুষের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি জনসমক্ষে বহু ভাষণ প্রদান করেছেন। সেই ভাষণগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণটি। এই ভাষণই ছিল বাঙালি জাতির দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনা আর অবহেলা থেকে মুক্তির ধারাবাহিক আন্দোলনের চূড়ান্ত নির্দেশনা।
ইতঃপূর্বে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর ও ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের উভয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে শপথ গ্রহণ করার আগে বঙ্গবন্ধুও তাঁর দলের সদস্যরা সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি পাকিস্তানি সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানকে অনতিবিলম্বে পালার্মেন্টের অধিবেশন ডাকার দাবি করে জানান, অধিবেশন হতে হবে ঢাকায়।

৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুরেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন। ৬—দফা ও ১১—দফার ভিত্তিতে দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও জনগণের প্রতি অনুগত থাকার শপথ গ্রহণ করেন সংসদ সদস্যরা। তারপর ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে দফায় দফায় ক্সবঠক অনুষ্ঠিত হয়। ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানে গমনের প্রাক্কালে ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদেরকে জানান যে, শেখ মুজিবুর রহমান শীঘ্রই পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। জাতীয় সংসদ অধিবেশনের বিষয়ে তিনি বলেন যে, সংসদ অধিবেশনের তারিখ এখনো ঠিক হয়নি, তবে শীঘ্রই অধিবেশন আহ্বান করা হবে এবং এজন্য প্রয়োজনে তিনি আবার ঢাকা আসতে পারেন। এটি ছিল দূরভিসন্ধিমুলক একটি বক্তব্য।
১৬ জানুয়ারি ইয়াহিয়া খান তাঁর সামরিক ও গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে করাচীতে এক গোপন আলোচনায় মিলিত হন এবং সেদিনই গণমাধ্যমকে জানানো হয় যে, রাষ্ট্রপতি পাখি শিকার করতে পরদিন করাচী ত্যাগ করবেন। ১৭ জানুয়ারি পাখি শিকারের নামে ৩টি হেলিকপটারে করে বিশাল দলটি জুলফিকার আলী ভুট্টোর লারকানার প্রাসাদের বাগানে অবতরণ করেন। সেই রাতে তারা পাখি শিকার করার পরিকল্পনা করেনি, কিন্তুবাঙালি শিকারের পরিকল্পনা করে। এই আলোচনাই ‘লারকানা ষড়যন্ত্র’ নামে পরিচিত।
এই ষড়যন্ত্রবাস্তবায়নের জন্যই সামনের দিনগুলোতে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, তারা কখনোই বাঙালির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ ক্সসন্য বাংলায় পাঠাবে। এই সময়টায় তারা বঙ্গবন্ধুসঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখে যেন তাদের আসল পরিকল্পনা জনসমক্ষে প্রকাশ না পায়।

এই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান সরকার একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করে। তারা বিমানবাহিনীর বিমান, পিআইএ’র কিছু বিমান ও হল্যান্ড থেকে ভাড়া করা কিছু বিমান এবং কয়েকটা বিশাল আকারের জাহাজ (যেমন: এমভি সোয়াত, এমভি এনডিওরেন্স) দ্বারা পূর্বপাকিস্তানে দ্রুত ক্সসন্য পাঠাতে থাকে। এদিকে তারা নিষ্ফল আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকে যেন জনগণের মধ্যে তাদের উদ্দেশ্য প্রচার না হয়।
বেলুচিস্তানের কসাই পাঞ্জাবি লে. জেনারেল টিক্কা খানকে ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক হিসেবে লে. জেনারেল ইয়াকুবের স্থালাভিষিক্ত করা হয়। ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বিশাল ক্সসন্যসমাবেশ, ইয়াহিয়ার ১লা মার্চে পার্লামেন্টের অধিবেশন স্থগিত করা ইত্যাদি তথ্য জানতে পারেন বঙ্গবন্ধু। তাই তিনি ১ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন ও হরতালের কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তিনি তখন বাঙালি জাতিকে একত্রিত করে ভবিষ্যতের সংগ্রামের প্রস্তুতির জন্য ও দিক নির্দেশনা প্রদানের জন্য ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ প্রদান করবেন বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
পূর্ব ঘোষণা মোতাবেক বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ৭ই মার্চ জনসমুদ্রে পরিণত হলো রেসকোর্স ময়দান। বিপদের সময় মানুষ সাহসী ও চরিত্রবান নেতৃত্বের নির্দেশনার আশ্রয় খোঁজে। এজন্যই গোটা জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল তাঁর ভাষণ শোনার জন্য।

বিকাল সাড়ে ৩টায় রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুতাঁর দিক নির্দেশনামূলক ভাষণ প্রদান করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে তাঁর এই ভাষণ এক অনন্য সাধারণ ভাষণ হিসেবে বিবেচিত। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি ছিল অলিখিত ভাষণ। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, হৃদয় দিয়ে যা অনুভব করতেন, তা—ই তিনি সেদিন বলেছিলেন। তিনি তাঁর ভাষণে দেশকে মুক্ত
করার জন্য আন্দোলনের ডাক দেন তথা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান
জানান। তিনি বলেন
“…. আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে…. রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। ….”
তিনি তাঁর ভাষণে দেশকে মুক্ত করতে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য বাঙালি জাতির প্রতি আহ্বান জানান এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। এটাই ছিল তাঁর স্বাধীনতার ডাক। তাঁর এই ভাষণ দেশবাসীকে প্রগাঢ় বৈপ্লবিক প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধুশুধুমাত্র তাঁর সামনে উপবিষ্ট ১০ লক্ষ মানুষের মাধ্যমে বাংলাদেশের আরও সাড়ে সাত কোটি অধিকার বঞ্চিত মানুষের উদ্দেশে এই ভাষণ দেননি, বিশের শত কোটি অত্যাচারিত ও শোষিত মানুষকে তিনি এই ভাষণ দ্বারা স্বাধীনতা অর্জনের প্রচেষ্টার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিলেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন।

বঙ্গবন্ধুতাঁর ভাষণে সেদিন বলেছিলেন: “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। আগুন ঝরে পড়ল তাঁর কণ্ঠ থেকে। কোনো ভাষাবিদ বা ভাষাতাত্ত্বিক না হয়েও বঙ্গবন্ধু তাঁর সেদিনের বক্তব্যের গভীরতা, স্পষ্টতা ও বাচনভঙ্গির জন্য তিনি স্মরণীয়। এই ভাষণের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত অফিস, আদালত, ¯‥ুল, কলেজ, ব্যাংকসহ প্রশাসন একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের মতো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে লাগল।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের নির্দেশনা ও ডাক। জাতির অস্তিত্বের লড়াইয়ে জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে অসম যুদ্ধে তিনি সেদিন অবতীর্ণ হয়েছিলেন জনগণের একজন হিসেবে। এই ভাষণের দিক নির্দেশনায় জাতি সেদিন থেকেই যুদ্ধ পথে চলে গিয়েছিল। তাঁর ভাষণে তিনি বাংলার মানুষের সংগ্রাম ও বঞ্চনার কথা সহজ ও সাবলীল ভঙ্গিতে উচ্চারণ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসন থেকে বাঙালির মুক্তির একমাত্র পথ হলো স্বাধীনতা, আর এই কথাটি তিনি তাঁর ভাষণের মাধ্যমে অত্যন্ত কে․শলে শ্রোতাদের মনে গেঁথে দিয়েছেন।
তাঁর ভাষণের প্রতিটি কথা মানুষের মনে গভীর দাগ কাটে। এই ভাষণটি বিশে^র নিপীড়িত ও অধিকার বঞ্চিত মানুষকে যুগে যুগে অধিকার আদায় ও স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য দিক নির্দেশনা প্রদান করবে। এই কারণেই তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণটি বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের দলিল হিসেবে ইউনেসকো কর্তৃক ২০১৭ সালের ৩০শে অক্টোবর মেমোরি অব দা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার
(Memory of the World International Register)—এর অন্তভুর্ক্ত করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে অনেকে বিশ্বের মহান নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস’, মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘I have a dream’, প্যাট্রিক হেনরির ‘Give me liberty or give me death’, ইত্যাদি ভাষণের সাথে তুলনা করেন। তবে তাঁদেরকে বঙ্গবন্ধুর মতো সাড়ে ৭ কোটি মানুষের আকাশ ছোঁয়া আশা—আকাক্সক্ষার চাপ ও সামরিক সরকারের অস্ত্রের মুখে সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে ভাষণ দিতে হয়নি।
বঙ্গবন্ধুতাঁর ভাষণের মাধ্যমে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তর করেছিলেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর উপর জনগণের প্রত্যাশা ও চাপ ছিল সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করার।
জাতি অপেক্ষায় ছিল তিনি কি আজই স্বাধীনতার ডাক দেবেন! বিশ্ববাসীও সেদিন উৎকণ্ঠিত ছিলেন। তাঁরা বুঝতে পারছিলেন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সাথে আর কোনো আপোশ করবেন না, তিনি বাঙালি জাতিকে এতদিন স্বাধীনতার যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন এবার সেই লক্ষ্য পূরণের দিকেই তিনি অগ্রসর হবেন। কিন্তু অত্যন্ত কে․শলী বঙ্গবন্ধুসরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না করে কে․শলে পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ডাক দিলেও পাশাপাশি তিনি পাকিস্তানি সামরিক সরকারের সাথে আলোচনার পথও খোলা রাখলেন।
তিনি জানতেন ঢাকায় অদূরবর্তী সেনানিবাসে পাকিস্তানিদের এক ব্রিগেড ক্সসন্য (১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ২২ বালুচ রেজিমেন্ট, ৩১ ফিল্ড রেজিমেন্ট, ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স, ৪টি সাঁজোয়া ট্যাংক), ১৬টি যুদ্ধবিমান ও ১৮টি সশস্ত্র
হেলিকপটার সেদিন প্রস্তুত ছিল আক্রমণের জন্য। সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে এই বিশাল বাহিনী লক্ষ লক্ষ
মানুষের উপর আক্রমণ রচনা করত।

তা ছাড়া পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দ্বারা সভাস্থলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দাঙ্গাহাঙ্গামার আশঙ্কাও ছিল। তিনি বুঝতেন যে, জনশক্তি যে—কোনো মারণাস্ত্রের চেয়ে শক্তিশালী।
পাকিস্তানিদের নির্মমতা, ভয়াবহ ষড়যন্ত্র ও সামরিকবাহিনীর অনিবার্য অভিযানের তথ্য ও বাঙালির অভ্যুদয় ঠেকাতে পাকিস্তানিদের অসীম তৎপরতার মাঝেও তিনি আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। অত্যাচারী জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে বঙ্গবন্ধুএই ভাষণ প্রদান করেন। কি অসাধারণ দেশপ্রেম থাকলে জীবনের পরোয়া না করে শত্রু পরিবেষ্টিত পরিবেশে নির্ভয়ে এমন বক্তব্য উপস্থাপন করা যায়! অস্তিত্বের লড়াইয়ে তিনি জনগণের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে এই ভাষণ প্রদান করেন।
মহান নেতা জনগণের হৃদয়ে নিজেকে স্থায়ী আসনে প্রতিষ্ঠা করেন। অধিকার বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ালেন স্বাধীনতার এই সিংহপুরুষ এবং এর মাধ্যমেই নতুন আশা সঞ্চারিত হলো। তাঁর ছিল কল্পনা শক্তি, প্রেরণা শক্তি আর অসাধারণ উপস্থিত বুদ্ধি। তিনি তাঁর বক্তৃতায় প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা না করেও অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন।
সেদিন তাঁর সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। হয় সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা অথবা পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব কাঁধে না নিয়ে, বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত না হয়ে সুচিন্তিত বক্তব্য প্রদান করা।

পাকিস্তানি সামরিক সরকার তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করার পথ খুঁজছিল। কিন্তু এই বিষয়ে তিনি সতর্ক ছিলেন বলে তাদেরকে এমন কোনো সুযোগই দেননি। তিনি যে একজন অত্যন্ত বিচক্ষণ নেতা ছিলেন তাঁর ভাষণের মাধ্যমে তিনি তা প্রমাণ করেছেন। ১,১০৮ শব্দ সংবলিত ১৮ মিনিট ৩১ সেকেন্ডের এই ভাষণের সাথে সাথেই কালজয়ী চেতনার মাধ্যমে ৭ই মার্চ বাঙালি জাতি যুদ্ধের পথে চলে যায়।
৭ই মার্চ ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য অন্তিম মুহূর্ত, বঙ্গবন্ধুর জীবনের নতুন দিগন্ত ও শ্রেষ্ঠ সময় আর বাঙালি জাতির জন্য স্বাধীনতার সিদ্ধান্তের মুহূর্ত। জাতি তাঁর নির্দেশে পথ চলা শুরুকরে। বঙ্গবন্ধুসাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে দীর্ঘ ২৩ বছরের অত্যাচার, অবিচার ও নিপীড়নের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। সেদিন তিনি ছিলেন দুরন্ত সময়ের এক জীবন্ত চলচ্চিত্র।
৭ মার্চের ভাষণের পর বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাঙালিরা যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন। এই প্রস্তুতির পেছনে ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালির আন্দোলন এবং নির্বাচনে বিজয়ের পরও ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসির বিরূপ প্রতিক্রিয়া।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ মূল্যায়ন করতে গিয়ে ইতিহাসবিদ ও গবেষকরা ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তুএকটি বিষয়ে দ্বিধাহীন চিত্তে সবাই অভিন্ন মত প্রকাশ করবেন ও স্বীকার করবেন যে, এটাই ছিল স্বাধীনতার ডাক এবং এই ভাষণই প্রমাণ করেছিল বঙ্গবন্ধুএকজন কুশলী রাষ্ট্রনায়ক।

ঐতিহাসিক রমনা রেসকোর্স ময়দান সংশ্লিষ্ট হাইকোর্টের রায়ে উল্লেখ আছে যে, “প্রতীয়মান হয় ৭ মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধু ‘স্বাধীনতার ডাক’ দিয়াছিলেন এবং ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ প্রদান করিয়াছিলেন।” মূলত ৭ই মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হয়। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ চলতে থাকে।
এরই ধারাবাহিকতায় ২৫শে মার্চ আক্রমণের সাথে সাথেই বাংলার মাটিতে জনযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ইতিহাসের ঝড়ো হাওয়া যখন একটি জাতির ভাগ্য অনিবার্যভাবে ভেঙে চুরমার করে দিতে থাকে তখন বাংলার মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বঙ্গবন্ধুসবাইকে আত্মোৎসর্গের জন্য প্রস্তুত হতে আহ্বান জানিয়েছিলেন।
কারণ নেতা জানতেন যে ভবিষ্যতে বাংলার মানুষের কল্যাণ, সংসারের শান্তি ও জীবনের সে․ন্দর্য নিহিত রয়েছে সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে। তিনি জানতেন এই মাটিতে নতুন জীবন জন্ম নিচ্ছে, যার জন্য বেদনা হবে প্রচুর কিন্তুসম্ভাবনা অজস্র। বাংলার মানুষ বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে বিশাল সোনালি ধানক্ষেত সৃষ্টি করেছেন এবং এত দূর এগিয়ে আসার পর তাঁরা আর পিছপা হবেন না।

হাজার বছরের বাঙালি জাতির অসম্পূর্ণ স্বাধীনতার গান সম্পন্ন করলেন তিনি। এই ভাষণে তিনি ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তান পার্লামেন্টে প্রদত্ত ভাষণে যে কথা বলেছিলেন “জুলুম মাত করো ভাই” সেই কথাই তিনি আবার স্মরণ করিয়ে দিলেন। যতই দিন যাবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশে^র নতুন প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
এই ভাষণ শুনে তারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাকে বিশ্ব দরবারে উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা
করবে। লন্ডন অবজারভার—এর সাংবাদিক Cyril Dunn তাই বলেছিলেন: “Mujib is a full blooded Bengali – his courage and charm that flowed from him made him a unique superman in these times.””
আরও পড়ুন:
“বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ ও প্রেক্ষাপট লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক”-এ 1-টি মন্তব্য