মুজিববর্ষে বিজয় দিবসের স্বপ্ন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
১.
যারা ১৯৭১ কে নিজের চোখে দেখেছে তাদেরকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্ত কোনটি তাহলে নিশ্চিতভাবেই তারা বলবে সেটি হচ্ছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। আমার মনে হয় যারা ১৯৭১ সালকে নিজের চোখে দেখেছে তারা পৃথিবীর সবচেয়ে সে․ভাগ্যবান মানুষ কারণ জীবনের সবচেয়ে দুঃসময়ে এই দেশের সাধারণ মানুষ যে নিজের জীবন বিপন্ন করে কতো বড়ো আত্মত্যাগ করতে পারে, দেশকে কতো তীব্রভাবে ভালোবেসে কতো অবহেলায় নিজের প্রাণটি বিলিয়ে দিতে পারে এবং সবচেয়ে বড়ো কথা এই দেশের সবচেয়ে বড়ো অর্জনটি তারা কীভাবে ছিনিয়ে আনতে পারে সেটি নিজের চোখে
দেখেছে, তারা যদি সে․ভাগ্যবান না হয়, তাহলে কারা সে․ভাগ্যবান হবে?

আবার অন্যভাবে দেখলে তারা এক ধরনের দুর্ভাগা মানুষ হতে পারতো, কারণ তাদেরকে নিজের চোখে পৃথিবীর নৃশংসতম একটি গণহত্যা দেখতে হয়েছে, পাকিস্তানি মিলিটারি এবং তাদের পদলেহী অনুচরেরা যে কত নৃশংস হতে পারে সেটি দেখে তারা যদি
পুরো মানব জাতির ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতো তাহলেও অবাক হবার কিছু ছিল না।
সে․ভাগ্যক্রমে সেটি হয়নি, সময়ের কোমল পরশে, বিভীষিকার স্মৃতি আনন্দের স্মৃতি দিয়ে ঢাকা পড়েছে, দুঃখের তীব্রতা কমে সহনসীমায় এসেছে, মানুষ নূতন জীবনের স্বপ্ন দেখতে শিখেছে। তাই নিশ্চিতভাবে বলা যায় যারা ১৯৭১ দেখেছে তারা যে শুধু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থেকেছে তা নয়, তারা একই সাথে মানবতার এমন একটি রূপ দেখেছে যেটি সারা জীবনে কখনোই ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। এই দেশে যে মানুষগুলো সেই সময়টুকুর ভেতর দিয়ে এসেছে তাদের ভেতরে
একটি মে․লিক পরিবর্তন হয়ে গেছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো দুঃসময়টি নিজের চোখে দেখেছে বলে তারা এখন যেকোনো পরিস্থিতিতে অবিচল থাকতে পারে, ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারে, আশাবাদী হতে পারে। তাই আমি মনে করি আমাদের প্রজন্ম হচ্ছে একটি অতি সে․ভাগ্যবান প্রজন্ম।
২.
প্রায় অর্ধশতাব্দী বছর পরেও আমার ১৯৭১ এর বিজয় দিবসের কাছাকাছি দিনগুলোর কথা স্পষ্ট মনে পড়ে। ডিসেম্বরের শুরু থেকে অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে আমরা সবাই বুঝতে শুরু করেছি যুদ্ধের গতি প্রকৃতি পাল্টে গেছে, এটি শেষ হতে যাচ্ছে, তবে কত রক্তপাত হয়ে এটি শেষ হবে সেটি কেউ তখনো জানে না। বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ বিমানের ডগ ফাইট দেখা যায়। এন্টি এয়ার ক্রাফট গানের গুলির সুবিন্যস্ত আলোতে রাতের আকাশ আলোকিত, কর্কশ শব্দে দিকবিদিক প্রকম্পিত।
[ মুজিববর্ষে বিজয় দিবসের স্বপ্ন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল ]
মিলিটারি কনভয় যাচ্ছে, সেখানে নিষ্ঠুর চেহারার পাকিস্তানি মিলিটারি পাথরের মত মুখ করে বসে আছে। যারা ঢাকা শহরের প্রান্ত সীমানায় আছে তারা দেখছে পিচ করা রাস্তায় দাগ কেটে কেটে ঘর ঘর শব্দ করতে করতে ট্যাংক যাচ্ছে। কামানের গর্জন, নিরবিচ্ছিন্নভাবে শেলিং হচ্ছে। বিবিসিতে বলছে, আমেরিকার সপ্তম নে․বহর শত শত যুদ্ধ বিমান নিয়ে বঙ্গোপসাগর দিয়ে বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসছে।

স্থানীয় রেডিও খুললেই শোনা যাচ্ছে পাকিস্তানি মিলিটারিকে আত্মসমর্পন করার জন্যে ক্রমাগত বলা হচ্ছে “হাতিয়ার ঢাল দো” অস্ত্র সমর্পন কর! আকাশ থেকে লিফলেট ফেলা হচ্ছে সেখানে আত্মসমর্পণের অবিরাম আহ্বান। আমরা টের পাচ্ছি যুদ্ধ মানে শুধু গোলাগুলি নয় যুদ্ধ হচ্ছে একই সাথে প্রচণ্ড মানসিক চাপ! তখনও আমরা জানিনা জামাতে ইসলামির ছাত্র সংগঠন আল বদর বাহিনীরা নিশ্চিত পরাজয়ের আভাস পেয়ে এই দেশের সোনার সন্তানদের একজন একজন করে ধরে নিয়ে হত্যা করতে শুরু করেছে।
ডিসেম্বর মাস, প্রচণ্ড শীত, যেখানে আশ্রয় নিয়েছি সেখানে বেশ কিছু অবোধ শিশু, তাদের নিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে একটা বাংকারে নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছি। প্রচণ্ড অনিশ্চয়তা, কী হবে কেমন করে হবে আমরা কিছু জানি না। তখন হঠাৎ শুনতে পেলাম তীক্ষèগলায় একজন গলা ফাটিয়ে কোথা থেকে জানি চিৎকার করে উঠল, জয় বাংলা!
এক মুহূর্তেসকল অনিশ্চয়তা কোথায় উড়ে গেল, সকল দুর্ভাবনা মুছে গেল কেউ বলে দেয়নি কিন্তু বুঝে গেলাম যে দিনটির জন্য এতোদিন অপেক্ষা করে আছি, বনের পশুর মতো দেশের আনাচে কানাচে ছুটে বেড়িয়েছি সেই দিনের অবসান হয়েছে। যে দেশটির জন্য আমার কত আপনজন বুকের রক্ত দিয়েছে, সেই দেশটি আমাদের হাতে ধরা দিয়েছে। এর চাইতে আনন্দের আর কী হতে পারে, কিন্তু কী আশ্চর্য, প্রথম সেই খবরটি পাওয়ার পর আমাদের সবার চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু। আমার এখনও বিশ্বাস হয় না, এই দেশে সেই জয় বাংলা শ্লোগানটি কতো দীর্ঘ কাল নির্বাসিত ছিল।
৩.
অনেক স্বপ্ন নিয়ে দেশটি স্বাধীন হয়েছিল। সেই বিজয় দিবসটিতে আমরা সবাই নূতন জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলাম। দেশটি শত্রুমুক্ত হলেও বঙ্গবন্ধু তখনো পাকিস্তানের কারাগারে, জানুয়ারির ১০তারিখ তিনি ফিরে এলেন, আমাদের কী আনন্দ! তিনি আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার কাজে হাত দিলেন। দেশে তখন লক্ষ লক্ষ ঘর—বাড়িহীন মানুষ, বাবা হারানো পরিবার, ছেলে হারানো মা, নির্যাতিতা মেয়ে, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা, হতদরিদ্র দেশের মানুষ। তাদের অনেকের ঘর নেই বাড়ি নেই, মাথা গেঁাজার জায়গা নেই, মুখে দেওয়ার খাবার নেই।
দেশে রাস্তা—ঘাট নেই, যুদ্ধে ধ্বংস হয়েছে বলে সেতু নেই। মিলিটারি ক্যাম্প করে ছিল বলে ¯‥ুল নেই, কলেজ নেই বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে বলে বই নেই খাতা নেই, অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়েছে, তবু এই দেশের মানুষের বুকে বিশাল প্রত্যাশা।নিশ্চয়ই এই দেশ মাথা তুলে দাঁড়াবে, যত শোষণ ছিল বঞ্চনা ছিল সেগুলো দূর হবে। এই দেশে অন্যায় থাকবে না, অধর্ম থাকবে না শুধু থাকবে সকল ধর্মের সকল বর্ণের সকল মানুষের জন্য বুক ভরা ভালোবাসা।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে সেই দেশ গড়ে তোলার সময় দেওয়া হলো না। সাড়ে তিন বছরের ভেতর আগস্ট মাসের ১৪ তারিখ ভোরবেলায় পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম একটি হত্যাকাণ্ডে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। বঙ্গবন্ধুর রক্তে রঞ্জিত হলো এই অভাগা দেশের মাটি, সেই মুহূর্তেআধুনিক বাংলাদেশটি পথ হারিয়ে আশাহীন স্বপ্নহীন ধর্মান্ধতার অন্ধকার কানাগলিতে হারিয়ে গেল। যে যুদ্ধাপরাধীদের তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য জেলখানায় রাখা হয়েছিল তারা ডিসেম্বর মাসের ৩১ তারিখ পিলপিল করে সেখান থেকে বের হয়ে এলো। এই দেশটি হয়ে গেল যুদ্ধাপরাধীদের অভয়ারণ্যে।
৪.
তারপর অনেক কিছু হয়েছে, সেই ইতিহাস কালিমাময়। একসময় বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যা কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আবার তার সেই হারানো পথ খুঁজে পেয়েছে। এই দেশে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করে দেশকে গ্লানিমুক্ত করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দেশটিকে তার হারিয়ে যাওয়া আত্মসম্মান ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিশু কিশোরেরা আবার বঙ্গবন্ধুর কথা জানতে পারছে, তারা আবার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অহংকার করতে শিখেছে। দেশটির অর্থ‣নতিক সক্ষমতা লাফিয়ে লাফিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, কার দুঃসাহস আছে এখন এই দেশটিকে তলাহীন বাে¯‥ট বলবে?
কিন্তু আমাদের ১৯৭১ এর স্বপ্নকি পূরণ হয়েছে? আমরা সবাই জানি সত্যিকারের স্বপ্ন হয় আকাশ ছেঁায়া তাই সেই স্বপ্ন কখনোই পূরণ হওয়ার নয়, আমরা সারা জীবন শুধু সেই স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে কাজ করে যাই।
কিন্তু যদি কখনো দেখি আমরা চোখে সেই স্বপ্ন নেই, তখন দুর্ভাবনা হয়। আমাদের সামনে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ, প্রকৃতি নিয়ে চ্যালেঞ্জ, পরিবেশ নিয়ে চ্যালেঞ্জ, অর্থ‣নতিক ক্সবষম্য নিয়ে চ্যালেঞ্জ, শিক্ষা নিয়ে চ্যালেঞ্জ, স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে চ্যালেঞ্জ কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অসা¤প্রদায়িক দেশ ক্সতরির চ্যালেঞ্জ। বঙ্গবন্ধুর আজীবন স্বপ্ন ছিল একটি অসা¤প্রদায়িক বাংলাদেশ। আমরা সেই বাংলাদেশ এখনো পাইনি। বাংলাদেশে এখনো আমাদের ধর্মান্ধ মে․লবাদী গোষ্ঠীর আস্ফালন শুনতে
হয়।
মুজিববর্ষের এই বিজয় দিবসে আমাদের স্বপ্ন হোক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের একটি সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।
—
ডিসেম্বর ৭, ২০২০
মুহম্মদ জাফর ইকবাল (জন্ম: ২৩ ডিসেম্বর ১৯৫২) হলেন একজন বাংলাদেশী কথাসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখক, কলম লেখক, পদার্থবিদ, শিক্ষাবিদ ও আন্দোলনকর্মী। তার লেখা কিছু উপন্যাস চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে। তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের একজন অধ্যাপক এবং ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত একই বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ কৌশল বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। ২০১৯ সালের অক্টোবরে তিনি অবসরে চলে যান। তিনি ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ক্যলিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনলজি ও বেল কমিউনিকেশনস রিসার্চে ১৮ বছর কাজ করার পর তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত হন।
আরও :