বঙ্গবন্ধুর সরকার – সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও সুষম বণ্টন : বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক আদর্শ হলো সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি । অনেক সমালোচক বেশ জোর গলায় সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার কথা প্রকাশ করেছেন। এখানে সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার বিষয়টি প্রকাশের পূর্বে যে বিষয়টি ভালো করে অনুধাবন করা প্রয়োজন তা হলো, সমাজতন্ত্র কি? সমাজতন্ত্রের কমন কোনো গাণিতিক সূত্র নেই যেমন তিন আর দুই যোগ করলে পাঁচ হবে। যদি কেউ তিন আর দুই যোগ করে ছয় লেখেন তাহলে সেটি মিথ্যা বা ব্যর্থ বা ভুল বলা যায় ।
সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও সুষম বণ্টন

সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “সমাজতন্ত্রের জন্মভূমি সোভিয়েট রাশিয়ার ৫০ বছর পার হয়ে গেল, অথচ এখনও তারা সমাজতন্ত্র বুঝতে পারে নাই। …রাশিয়া যে পন্থা অবলম্বন করেছে, চীন তা করেনি- সে অন্যদিকে চলেছে। রাশিয়ার পাশে বাস করেও যুগোস্লাভিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া তাদের দেশের environment নিয়ে, তাদের জাতির background নিয়ে, সমাজতন্ত্রের অন্যপথে এসেছে।” বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্র বলতে যে বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন সেটি হলো শোষণহীন সমাজ। দেশের অর্থনৈতিক নীতিতে এমন এক ব্যবস্থা করা উচিত যাতে দেশের দুঃখী মানুষ protection পায় । ধনী-দরিদ্রদের বৈষম্য থাকবে না ।
এই প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “বিদেশ থেকে হাওলাত করে এনে কোনদিন সমাজতন্ত্র হয় না, তা যাঁরা করেছেন, তাঁরা কোনোদিন সমাজতন্ত্র করতে পারেননি। কারণ, লাইন, কমা, সেমিকোলন পড়ে সমাজতন্ত্র হয় না– যেমন আন্দোলন হয় না। সে জন্য দেশের environment, দেশের মানুষের অবস্থা, তাদের মনোবৃত্তি, তাদের কাস্টম, তাদের আর্থিক অবস্থা, তাদের মনোভাব, সবকিছু দেখে step by step এগিয়ে যেতে হয় ।
একদিনে সমাজতন্ত্র হয় না।” ১৯৭২ সালের ঐতিহাসিক ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণে জাতির আদর্শ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু ৪টা স্তম্ভের কথা উল্লেখ করেন । যার একটি স্তম্ভ হলো সমাজতন্ত্র । সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন “এ সমাজতন্ত্র আমি দুনিয়া থেকে ভাড়া করে আনতে চাই না, এ সমাজতন্ত্র হবে বাংলার মাটির সমাজতন্ত্র।
এ সমাজতন্ত্র বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র, তার অর্থ হলো শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বণ্টন। বাংলাদেশে ধনীদের আমি আর ধনসম্পদ বাড়াতে দেবো না। বাংলার কৃষক, মজদুর, বাংলার বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক এদেশে সমাজতন্ত্রের সুবিধা ভোগ করবে।” এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আরও একটি বক্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তা হলো- ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতীয়করণের নীতি ঘোষণা উপলক্ষে বেতার টেলিভিশনে তিনি বলেন :
“সম্পদের বণ্টনব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে এবং উচ্চতর আয় ও নিম্নতম উপার্জনের ক্ষেত্রে যে আকাশচুম্বী বৈষম্য এতদিন ধরে বিরাজ করছিল সেটা দূর করার ব্যবস্থাদি উদ্ভাবনের জন্যে আমি একটি বিশেষ কমিটি গঠন করার কথা বিবেচনা করছি।”
সুতরাং দেশের সার্বিক ব্যবস্থা, environment, মানুষের মনোভাব ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন এমন একটি শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা যেখানে দেশের সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে। বঙ্গবন্ধুর এই সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক নীতির কেন্দ্রে ছিলো বাংলার দুঃখী মানুষের অবস্থার উন্নতি তিনি চেয়েছিলেন বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে।
বঙ্গবন্ধু ডাক্তার, নার্স, শ্রমিক, কৃষক, পুলিশ, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, নৌবাহিনী, জাতীয় সংসদ বা জাতির উদ্দেশে যে সমাবেশেই বক্তৃতা করেছেন সব সময়ই দেশের গরিব-দুঃখী মানুষের কথা বারবার উচ্চারণ করেছেন। ১৯৭২ সালের ৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু পিজি হাসপাতালের রক্ত সংরক্ষণাগার এবং নতুন মহিলা ওয়ার্ডের উদ্বোধন উপলক্ষে ভাষণে বলেন, “সাদা কাপড়-চোপড় দেখলেই কেন তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেন?
আর দুঃখী মানুষ আসলেই কেন তাকে রাস্তায় বাইর করে দেন, বয় বলে চিৎকার করেন?” একই সমাবেশে তিনি আরও বলেছেন:
“আমি দেখেছি। যে, মেডিকেল কলেজের সামনে দুঃখী, নেংটা পড়ে আছে, তিন দিন পর্যন্ত পড়ে আছে – তাকে কেউ জিজ্ঞাসা করে না, আর বড় গাড়ি করে যখন কেউ হাজির হয় তখন সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসেন সাহেব।”
১৯৭৪ সালে ১৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে উদ্বোধনী ভাষণে বলেন “আমি যদি বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে না পারি, আমি যদি দেখি বাংলার মানুষ দুঃখী, আর যদি দেখি বাংলার মানুষ পেট ভরে খায় নাই, তাহলে আমি শান্তিতে মরতে পারব না-পারব না-পারব না। আমার জীবন বৃথা হয়ে যাবে।”
১৯৭৫ সালে ১১ জানুয়ারি সামরিক একাডেমিতে প্রথম শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে বিদায়ী ক্যাডেটদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন “আমি দেখতে চাই সোনার বাংলা । আমি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই। আমি আরও দেখতে চাই এদেশের দুঃখী মানুষ পেট ভরে খেতে পাচ্ছে। তাদের গায়ে কাপড় আছে, অত্যাচার-অবিচার বন্ধ হয়ে গেছে।”
১৯৭৫ সালে ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রথম পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন:
“আপনারা মানুষের সেবা করুন। মানুষের সেবার মতো শাস্তি দুনিয়ায় আর কিছুতেই হয় না। একটা গরিব যদি হাত তুলে আপনাকে দোয়া করে, আল্লাহ সেটা কবুল করে নেন। এজন্য কোনদিন যেন গরিব দুঃখীর ওপর, কোনোদিন যারা অত্যাচার করেনি, তাদের ওপর অত্যাচার না হয় । যদি হয় আমাদের স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে।”
১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন:
“রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যায় যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসে। যদি দুঃখী মানুষ পেটভরে ভাত খেতে না পারে, কাপড় পরতে না পারে, বেকার সমস্যা দূর না হয়, তাহলে মানুষের জীবনে শান্তি ফিরে আসতে পারে না।”
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রথম জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনের দ্বিতীয় বৈঠকে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর ওপর আলোচনা কালে বঙ্গবন্ধু আঠারো বার শুধু দুঃখী মানুষের কথাই উচ্চারণ করেছেন। সুতরাং এটি ব্যাখ্যার আর প্রয়োজন পড়ে না যে বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মূল লক্ষ্য ছিল সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে বাংলার গরিব-দুঃখী মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ।
দুঃখী মানুষের অবস্থার উন্নয়নকল্পে যে কাজটি সর্বপ্রথম প্রয়োজন, তা হলো ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য হ্রাস করা, দেশের সম্পদের মালিকানায় দরিদ্রদের নিয়ে আসা। তারই অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু যে কাজটি প্রথমেই করেছিলেন তা হলো দেশের অধিকাংশ মিল, কল-কারখানা, ব্যাংক-বীমা, কাপড়ের কল, জুট মিল, সুগার ইন্ডাস্ট্রি ইত্যাদি যেখানে গুটি কয়েক ধনীক শ্রেণির মালিকানায় ছিলো তা জাতীয়করণের মাধ্যমে দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মালিকানায় নিয়ে আসেন।

এই জাতীয়করণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠা করলেন শাসক গোষ্ঠীর গণতন্ত্রের পরিবর্তে শোষিতের গণতন্ত্র । অনেকেই বঙ্গবন্ধুর এই জাতীয়করণ নীতির সমালোচনা করেন । দেশের কল-কারখানা লোকসানের পিছনে জাতীয়করণকেই দায়ী করে থাকেন ।
কিন্তু একটি কথা স্বীকার করতেই হবে তা হলো রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলো আজ ধ্বংসের পিছনে অন্যতম কারণ হলো বঙ্গবন্ধু পরবর্তী সরকারের অব্যবস্থাপনা, চরম দুর্নীতি ইত্যাদি । জাতীয়করণ কোনো প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের কারণ নয়। একটি উদাহরণ দেওয়া যায় এভাবে যে, দেশের অনেক ব্যাংক বেসরকারি মালিকানায় রয়েছে আবার চারটি ব্যাংক ছিল জাতীয়করণকৃত (সোনালী, জনতা, অগ্রণী এবং রূপালী ব্যাংক) ।
আমানত ব্যাংকের অন্যতম একটি কার্যক্রম, পর্যাপ্ত আমানত ব্যতীত কোন ব্যাংক তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না বা লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী মুনাফা অর্জন করতে পারে না। এ প্রেক্ষিতে যদি দেশের আমানতকারীদের তথ্য সংগ্রহ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে অধিকাংশ আমানতকারীই রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকে তাদের আমানত জমা রাখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে সঞ্চয় জমা রাখতে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। এখন প্রশ্ন আসতে পারে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে লোকসান হয় কেন? এর উত্তর হলো ব্যাংকের অব্যবস্থাপনা, ঋণ প্রদানে নিয়মনীতি অনুসরণ না করা ইত্যাদি । মালিকানা রাষ্ট্রীয় এটি লোকসানের কোন কারণ নয়।
বঙ্গবন্ধু দেশের ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য হ্রাসে যথার্থভাবেই অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করেছিলেন । তাঁর এই কার্যক্রমের যথার্থতার প্রমাণ পাওয়া যায়, ১৯৭৫ পরবর্তী সরকারগুলো যখন মুক্তবাজার অর্থনীতিকে লক্ষ্য রেখে বিরাষ্ট্রীয়করণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং আস্তে আস্তে অধিকাংশ শিল্প-কারখানা ব্যক্তি মালিকানায় চলে আসে।
এমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায় তা হলো দেশের অর্থনৈতিক প্রভূত উন্নতি সাধিত হলেও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য অনেকাংশে বেড়ে যায় দেশের মোট ভূমির ৪০ শতাংশের মালিক হচ্ছে মাত্র ৬.২০ শতাংশ জনগণ। পক্ষান্তরে ৫০ শতাংশ জনগণ হচ্ছে ভূমিহীন। ব্যাংকে বৃহৎ অংকের আমানতকারীর সংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, ক্ষুদ্র আমানতকারীর সংখ্যা সে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না ।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা অর্থনৈতিক সুশাসন কায়েমে পণ্যের সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা অতি প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। সাম্প্রতিককালে দেশে পণ্যের উৎপাদন পর্যায়ে উৎপাদকের সঠিক মূল্য প্রাপ্তি এবং ভোক্তা ন্যায্যমূল্যে পণ্য প্রাপ্তি দুটি নিয়েই রয়েছে যথেষ্ট অসংগতি বিশেষ করে কৃষিপণ্য বা কৃষি-উপকরণ বাজারজাতকরণে এই সমস্যাটি অতি প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। অধিকাংশ কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে দেখা যায় কৃষক অতি কষ্ট করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে পণ্য উৎপাদন করছে সে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে কম মূল্যে। আবার সেই পণ্যই ভোক্তাকে ক্রয় করতে হচ্ছে অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যে।
উদাহরণস্বরূপ প্রতি কেজি ধানের উৎপাদন খরচ হচ্ছে ১৩.৭৩ টাকা (২০০৯ সালের ধানের উৎপাদন ব্যয় অনুযায়ী) অথচ কৃষককে সেই ধান বিক্রি করতে হচ্ছে ১০ টাকায় ফলে কৃষককে প্রতি কেজি ধান চাষে লোকসান গুণতে হচ্ছে ৩.৭৩ টাকা। সেই ধান থেকে উৎপাদিত চাল যার খরচ হয় আনুমানিক ২০ টাকা যা ভোক্তাকে ক্রয় করতে হচ্ছে ৩০ টাকায় বা তার চেয়ে বেশি দামে।
অনুরূপভাবে কৃষি-উপকরণ সার বণ্টন ব্যবস্থা নিয়ে রয়েছে অভিযোগ কোন কোন সময় সরকার সার কৃষকের হাতে পৌঁছাচ্ছে খোলা বাজারে বিক্রির মাধ্যমে সেক্ষেত্রে কৃষককে সার কিনতে হচ্ছে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অধিক মূল্যে আবার কোন কোন সময় সরকার সার কৃষকের হাতে পৌঁছাচ্ছে নির্ধারিত ডিলারের মাধ্যমে। ডিলারের মাধ্যমে সার সংগ্রহে কৃষককে সারা রাত জেগে লাইনে দাঁড়িয়ে সার সংগ্রহ করতে হয়েছে। এমনকি সার সংগ্রহ করতে কৃষককে আন্দোলন পর্যন্ত করতে হয়েছে। পণ্যের বণ্টন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রতিকূল অবস্থার অন্যতম কারণ হচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ী, কালোবাজারি, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ব ইত্যাদি ।
একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় আইন শৃংঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি দেশে ব্যাপকভাবে বিরাজ করছিল। এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পিছনে এগুলো বেশ ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু কেন এ অবস্থা হয়েছিল তা একটু বিশ্লেষণ করলেই বোঝা সম্ভব। ১৯৭২-৭৩ সালের গোড়ার দিকে দেশে পুলিশবাহিনীর সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য, সর্বসাকুল্যে তেত্রিশ হাজারেরও কম। তাদের হাতে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ছাড়া কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না।
বিপরীতে সমাজবিরোধীদের হাতে ছিল পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া অটোমেটিক আগ্নেয়াস্ত্র পুলিশবাহিনীর চলাচলের জন্য যানবাহন ছিল না বললেই চলে। বস্তুত বাংলাদেশের আইন-শৃংঙ্খলা পরিস্থিতির সামাল দেওয়ার জন্য ১৯৭৩ সালের গোড়ার দিকে বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম ভারত থেকে পাওয়া মাত্র ১০ খানা উইলি জিপ ঢাকা পুলিশকে প্রদান করেন। ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে রাশিয়া থেকে মাত্র কয়েক ডজন মস্কোভা জিপ বার্টার ট্রেড-এর মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়।
১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে সর্বপ্রথম ঢাকায় ১০ খানা টয়োটা ফোর হুইলি জিপ সরবরাহ করা হয় ঢাকা পুলিশ চলাচলের জন্য। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যে বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা হলো বঙ্গবন্ধু সরকার বণ্টন ব্যবস্থার এই সমস্যাগুলি বেশ গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করে তা দূর করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।
১৯৭২ সালে ১ মে মহান মে দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণদান কালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন “আমাদের সমগ্র পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অংশের মধ্যে রয়েছে বণ্টন ও সরবরাহ ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করা। ইতিমধ্যেই বেসরকারি ডিলার, এজেন্ট এবং সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে যে, যদি তারা অসাধু ও সমাজবিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ না করে তাহলে তাদের সকল লাইসেন্স, পারমিট বাতিল করে দেওয়া হবে।
আশু ব্যবস্থা হিসেবে সরকার প্রতি ইউনিয়নে ও সমস্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সমবায় ভিত্তিতে ন্যায্য মূল্যের দোকান খোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর ফলে বেসরকারি ব্যক্তিদের বণ্টনের ক্ষেত্রে একচেটিয়া কর্তৃত্বের অবসান ঘটবে এবং সরবরাহের ক্ষেত্রে সাময়িক স্বল্পতার সুযোগে যুক্তিহীন মূল্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা রোধ হবে।”
বঙ্গবন্ধু সরকারের এই বণ্টন ও সরবরাহ ব্যবস্থার পরিকল্পনা অনুযায়ী কতিপয় প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছিল । সরবরাহের পরিমাণ অনুযায়ী বিভিন্ন জেলার লোকসংখ্যার ভিত্তিতে অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদি বণ্টনের নীতি ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল । জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদির বিতরণ ব্যবস্থা সুষ্ঠতর করার জন্য গণপ্রতিনিধি, প্রশাসক এবং শিল্প ও বনিক সমিতির সভাপতিসহ উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ বাণিজ্য কর্পোরেশন, ভোগ্যপণ্য সরবরাহ সংস্থা ও ভোক্তা সমবায় সমিতিসমূহকে সাংগঠনিক পর্যায়ে সুসংহত করার ও প্রকৃত ব্যবসায়ীদেরকে উৎসাহ দেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। উৎপাদন ও বিতরণের সম্প্রসারণে মধ্যস্বত্বভোগীদের কোন প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই বলে বিতরণ ব্যবস্থা থেকে তাদেরকে ক্রমান্বয়ে উৎখাত করার নীতি বাস্তবায়িত করতে বঙ্গবন্ধু সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। পণ্যের সুষ্ঠু বণ্টন ও সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিতকল্পে এই সকল পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দ্রব্যের মূল্য অনেকটাই স্থিতিশীল হয়েছিল ।
আরও পড়ুন:
“সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও সুষম বণ্টন”-এ 1-টি মন্তব্য