২১ জুলাই ১৯৭৫ – বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্ণরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

২১ জুলাই ১৯৭৫ ১ম সালের বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্ণরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণঃ কি উদ্দেশ্যে আপনারা এখানে এসেছেন, সকলেই জানেন। তবু আমি দুই একটা কথা আপনাদের সাথে আলোচনা করতে চাই। কারণ, আপনারা যারা নবনিযুক্ত গভর্ণর- তাদের প্রায় দুই-তিন সপ্তাহ প্রশিক্ষণ হবে এবং নানা বিষয় তাদের শিখতে হবে, জানতে হবে।

 

২১ জুলাই ১৯৭৫ ১ম সালের বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্ণরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
২১ জুলাই ১৯৭৫ ১ম সালের বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্ণরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

 

২১ জুলাই ১৯৭৫ ১ম সালের বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্ণরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

যারা বহুদিন যাবৎ আমার সহকর্মী, তারা জানেন, স্বাধীনতার পূর্বে এবং পরে বার বার আপনাদের সাথে আলোচনা করেছি এবং নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেও দেখেছি যে, প্রশাসনিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন দরকার। যে কোন কারণেই হোক, ইংরেজ যে শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছিল, সেটা শাসন বা শোষণ করবার জন্যই কায়েম করেছিল । কিন্তু আমরা স্বাধীনতা পেলাম, আমাদের চিন্তাধারায় আমূল পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল।

বহুদিন পর্যস্ত পুরনো আমলের মনোভাব নিয়ে আমরা কাজ করেছি। যে ট্রেনিং আমরা আগে পেয়েছি, সেটা পুরনো ঘুণে ধরা সিস্টেম ছাড়া আর কিছু নয়। আপনারা আজ জনগণের শাসক নন। আজ আমরা স্বাধীনতা এনেছি। আজকে আমরা স্বাধীন সার্বভৌম সরকার পরিচালনা করছি। আমরা এ দেশের শাসক নই, আমরা এ দেশের সেবক- একথা মনে রাখতে হবে । জনগণের সেবার জন্যই আমরা নির্বাচিত হয়েছি এবং তাদের সেবাতেই আমাদের আত্মনিয়োগ করতে হবে।

আপনারা যারা বহুদিন যাবৎ এ দেশের শাসনের সাথে বা প্রশাসনের সাথে জড়িত আছেন, তারা দেখেছেন- অভিজ্ঞতা থেকে দেখছেন, কাজের মাধ্যমে দেখেছেন যে, জনগণ থেকে আমাদের শাসন কাঠামো অনেকটা বিচ্ছিন্ন, প্রকৃত যোগাযোগ তাদের সাথে ততটা নাই। যারাই আমরা আমরাই হলাম মালিক, তোমরা আমাদের গোলাম । তোমরা এসো,আমাদের বাড়ির দরজায় দাড়িয়ে থাকো, আমাদের হুকুম নাও, আমাদের হুকুম মতো চলো, আমাদের হুকুম মতো কাজ করো, এই ছিল মনোভাব।

কোন স্বাধীন দেশে এই মনোভাব চলতে পারে না। তাতে দেশের মঙ্গল হয় না, তাতে দেশের অমঙ্গল টেনে আনা হয়। এটা বিস্তারিত আলোচনা না করলেও আপনারা বুঝতে পারবেন। বক্তৃতা করে বোঝাবার ক্ষমতা আমার নেই । আপনারা বহুদিন যাবৎ এই প্রশাসন যন্ত্রের সাথে জড়িত আছেন এবং বহুদিন যাবৎ রাজনীতি করছেন। সেজন্য আমি আপনাদের বোঝাতে চাইও না। কিন্ত একথা সত্যি, এই চিন্তাধারা আমার ও আমার সহকর্মীদের মনে ছিল যে, এর আমূল পরিবর্তন দরকার । দুনিয়ার অনেক দেশে দেখেছি, কোথাও প্রেসিডেলিয়াল পদ্ধতির সরকার, তাদের এক রকম চলে ।

কোথাও পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার, তাদের এক রকম চলে । কোথাও বা আছে মিক্সড পদ্ধতির সরকার, তাদের অন্য রকম চলে । কিন্তু আমার বাংলাদেশের যে সমস্যা এবং বাংলাদেশের যে অবস্থা, তাতে সম্পূর্ণরূপে ভাড়া করে কোনটা চালানো আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়। আমাদের নিজস্ব পদ্ধতি থাকতে হবে। কারণ, আমাদের মানুষকে চিনতে হবে, জানতে হবে । তাদের সাথে মিশতে হবে, তাদের মনোভাব জানতে হবে।

তাদের ইতিহাস এবং অন্য যা কিছু আছে সংস্কার ইত্যাদি অনেক কিছুই এ-দেশের মানুষের আছে- সেসব বিবেচনা করে একটা পন্থা অবলম্বন করা দরকার । যার উদ্দেশ্য হলো এ দেশের মানুষের মঙ্গল করা,-এ দেশের উপর থেকে অত্যাচার, অবিচার ও জুলুম উৎখাত করা । যাতে সহজে ও সরলভাবে মানুষের মধ্যে সোজাসুজি শাসনতান্ত্রিক কাঠামো পৌছে দেওয়া যায়। আজকে যে সিস্টেমটা করা হয়েছে, সেটা নতুন। পার্লামেন্টের মেম্বাররা বা সংসদ সদস্যরা লোকালি শীসন পরিচালনা করেন, এমন নজীর দুনিয়ার ইতিহাসে নাই। এই পদ্ধতিতে এ্যাপয়েন্টেড গভর্ণর, এ্যাপয়েন্টেড ম্যাজিস্ট্রেট আছেন।

এমনি অনেক কিছুই আমরা এখানে দিয়েছি যা অন্য কোথাও নাই । এটা একটা নতুন এক্সপেরিমেন্ট । এখন দেখা দরকার, এর উপর নির্ভর করে বাংলাদেশের জনগণের কতটা মঙ্গল করতে পারবো এবং যে আদর্শে উদ্ধুদ্ধ হয়ে কাজ করেছি, এর মাধ্যমে তার বাস্তবায়নে কতটা কৃতকার্য হবো । আজ আমরা কি দেখতে পাচ্ছি, সেটা পরিস্কার করে বলা যাক। আজ ৬১টি জেলা করা হলো। এর কারণ আছে। বাংলাদেশের কমিউনিকেশন সিস্টেম অত্যন্ত খারাপ। বোধহয় দুনিয়ার আর কোথাও এতো খারাপ ২৩৯

সিস্টেম নাই। একজন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্টেটের পক্ষে ৩৫ লাখ, ৪০ লাখ, ৫০ লাখ, ৬০ লাখ লোকের উপর বসে থেকে সুচারুরূপে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করা সম্ভব নয়। চেষ্টা করলেও তা হয় না। দুনিয়ার অনেক দেশের লোকসংখ্যা ১ লাখ থেকে ১০ লাখ, ২০ লাখ বা ২৫ লাখ। আমাদের এমন নতুন ডিস্টিক্টও আছে, যার লোক সংখ্যা তাদের চেয়ে অনেক বেশী । ময়মনসিংহ সদর নামে যে ডিস্টিক্ট করেছি, তার লোকসংখ্যা ৩০ লাখের কম নয়।

কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুর, নেত্রকোনা, চাদপুর এবং এমনি আরো অনেক জেলায় ১৫ লাখ, ২০ লাখ, ২৫ লাখ পর্যন্ত লোকসংখ্যা রয়েছে। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্টেটদের তেমন সুযোগ কোথায় যে, ৪০ লাখ, ৫০ লাখ, ৬০ লাখ লোকের একটা প্রশাসন একটা জেলায় বসে সুপারভাইস করবেন? কেমন করে দেখবেন, কোন ইউনিয়নের মধ্যে কি হচ্ছে? কিসের মধ্যে কি হচ্ছে। আরো কটি ডিস্ট্রিক্ট আছে। অনেক সময় দেখা যায়, আমাদের সরকারি কর্মচারীদের যখন বদলি করে দেওয়া হয়, তখন তারা ডিস্টিক্টে যান ও থাকেন। তারপর আবার যখন দরকার পড়ে, তারা চলে আসেন ।

 

২১ জুলাই ১৯৭৫ ১ম সালের বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্ণরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
২১ জুলাই ১৯৭৫ ১ম সালের বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্ণরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

 

তাদের পছন্দ হোক বা না হোক। ভালো কাজ করলে সুনাম নিয়ে চলে আসেন আর খারাপ কাজ করলেও সোজা চলে আসেন। কারণ, ভবিষ্যতে তাদের আর সেখানে যাবার প্রয়োজন নাই। সেজন্য আজ একটা বিরাট কিছু চিন্তা করতে হবে। স্থানীয় এম.পি সাহেবদের, রাজনীতিবিদদের আমি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে স্থানীয় গভর্ণর হিসেবে গ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছি। তাদের বিশ্বাস করে অনেক বেশি দ্বায়িত্ব দিয়েছি । কারণ, আমরা বুঝি লোকালি নিজেদের মধ্যে দলাদলি থাকে, একজন একজনকে পছন্দ করেন, একজন আর একজনকে পছন্দ করেন না। এছাড়া নিজের পার্টি আগে ছিল।

অন্য দলও । নানা রকম জিনিস আছে। আত্রীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব থাকে, কুটুন্ব-সাক্ষাৎ থাকে। বড় ভীষণ ব্যাপার। যদি আপনারা এ-সমস্ত জিনিসের উর্দে না উঠতে পারেন, তাহলে যে নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তার কি অবস্থা হবে, তা বলতে, তা ভাবতে আমার ভয় হয় । আপনাদের স্বজনপ্রীতির উধ্র্বে উঠতে হবে । গভর্ণরশীপের যে ক্ষমতা আমরা আইনে দিয়েছি, তা কম নয়। আমরা সোজাসুজি কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে জেলার কানেকশন রাখতে চাই।

তেমনি সরাসরি জেলার সাথে থানার, থানার সাথ ইউনিয়নের কানেকশন রাখতে হবে। এখন আপনারা চিন্তা করে দেখুন। যে ক্ষমতা আইনে গভর্ণরদের দেওয়া হয়েছে, তা আগে একজন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটও ভোগ করে নাই। তারচেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা আপনাদের দেয়া হয়েছে। আপনাদের যে দায়িতৃ দেয়া হয়েছে, তার সাথে সাথে কাউন্সিল করে দেয়া হয়েছে । সেখানে পার্টি থাকবে । পার্টির যিনি সেক্রেটারি থাকবেন, আপনার চেয়ে তার ক্ষমতা কোন অংশে কম থাকবে না। একদিকে আপনি যেমন রেসপনসিবল ফর দ্য এ্যাডমিনিস্ট্রেশন, তেমনি পার্টির যিনি সেক্রেটারি থাকবেন তিনিও রেসপনসিবল সমস্ত পার্টির জন্য ।

যখন গভর্ণর সাহেব কাউন্সিল মিটিং কল করবেন, তখন নিশ্চই সেক্রেটারি সেখানে উপস্থিত হবেন। আবার, যখন সেক্রেটারি সাহেব পার্টি মিটিং কল করবেন, তখন গভর্ণর সাহেব তার সামনে গিয়ে বসবেন, এটা ভূললে চলবে না। কিন্তু যে কথা আমি আগে বলেছিলাম । আপনাদের মহা বিপদ | বিশেষ করে, পার্লামেন্টের যেসব মেম্বার বা যে সমস্ত লোকাল গভর্ণর হয়েছেন, তাদের রেসপনসিবিলিটি কতখানি, তা আপনারা ভেবে দেখবেন ।

আমি আমার সাথে বহুদিন রাজনীতি করেছেন, তাদের আমি চিনি এবং তাদের উপর বিশ্বাস আর আস্থা আছে বলেই আমি তাদের গভর্ণর করেছি। কিন্তু বিশ্বাস এবং আস্থা আপনাদেরও রাখার কর্তব্য রয়েছে । আমার বিশ্বাস এবং আস্থা আপনাদের উপর রেখেছি। সেই জন্য আপনাদের গভর্ণর করেছি। পাস করে বাড়ি যাবেন, দেখবেন, শুনবেন। কিন্তু এখানে আপনাদের রেসপনসিবিলিটি দিয়েছি।

কারণ, দেখা যায়, বাংলার জনগণ পার্লামেন্টের মেম্বারদের এই আশায় ভোট দেয় যে, তারা সব কাজ করে দেবেন। কিন্ত আইন পাস ছাড়া তাদের রেসপনসিবিলিটি এমন কিছু নাই। কিন্তু লায়াবিটি তাদের বেশি। তাদের গালাগালি খেতে হয়। কিন্তু শাসন তারা চালাতে পারেন না। সেই জন্য আমি নতুন সিস্টেমে যাচ্ছি। আপনারা রেসপনসিবিলিটি নিন, আইনও পাস করুন। মাঠে ময়দানে কাজ করলে আপনারা সবই বুঝতে পারবেন। এখানে একটি কথা বলবো। আপনাদের কেউ কেউ এমন জেলায় গভর্ণর হয়েছেন, যেখানে আপনাদের নিজেদের বাড়ি-ঘর, নিজেদের আত্রীয়-স্বজন, নিজেদের পার্টি রয়েছে।

তারা সাবধান । তাদের স্বজনপ্রীতির উধের্ব উঠতে হবে- দুর্ণীতির উর্ধ্বে উঠতে হবে, আত্রীয়-স্বজনকে সাহায্য করার উর্ধেব উঠতে হবে, তাদের একটি রিক্ষ আছে। আপনাদের যারা পার্লামেন্ট মেম্বার, সবচেয়ে বড় রিস্ক তাদের। সেটা কি জানেন, যদি আপনারা কৃতকার্য না হতে পারেন, যদি মানুষ আপনাদের ভালো না বাসে, আপনারা মানুষকে যদি খুশি করতে না পারেন- তাহলে অসুবিধায় পড়বেন । পার্লামেন্টের মেম্বাররা আগে ছাড়া পেতে পারতেন । কোন রকমে লুকিয়ে রাখতে পারতেন । কিন্তু এবার সুদ-আসলে দুটোই যাবার সম্ভাবনা আছে। গভর্ণর সাহেবদের ভয় থাকা দরকার ।

আপনাদের চার্জ দেওয়া হয়েছে । আপনারা এবার কর্মস্থলে গিয়ে কাজ করুন। ল এন্ড অর্ডার আপনাদের দেখতে হবে। ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্ক আপনাদের দেখতে হবে। জিনিসপত্র বিদেশ থেকে যা আসে, তার ডিস্ট্রিবিউশন ঠিকমত হচ্ছে কিনা, দেখতে হবে। ওয়ার্কস প্রোগ্রামের টাকা আপনাদের দেখতে হবে। ফ্যামিলি প্ল্যানিং আপনাদের দেখতে হবে। পাবলিসিটি আপনাদের দেখতে হবে। উৎপাদন বৃদ্ধি হচ্ছে কিনা, আপনাদের দেখতে হবে । খাল কাটা হচ্ছে কিনা, আপনাদের দেখতে হবে । ঘুষ খাওয়া বন্ধ হয়েছে কিনা, আপনাদের দেখতে হবে। থানার মধ্যে করাপশন আছে কিনা, আপনাদের দেখতে হবে ।

আপনাদের সাথে থাকবেন ম্যাজিস্ট্রেট । আপনাদের সাথে থাকবেন এস.পি, আপনাদের সাথে থাকবেন জয়েন্ট এস.পি(ক্রাইম)। আপনাদের সাথে থাকবেন সমস্ত অফিসার, – আপনাদের সাথে থাকবেন রাজনৈতিক কর্মীরা । আপনাদের একটি কাউন্সিল হবে । কাউন্সিলকে আপনাদের কনফিডেন্স-এ নিতে হবে । কাউন্সিলকে বাদ দিয়ে নিজে সব সময় ডিক্টেটরশীপ করতে যাবেন না। কাউন্সিল ডেকে তাদের সাথে আলোচনা করে কাজ করতে হবে ।

কিন্তু আজকে মেম্বার সাহেবের একটি বড় ভয়ের ব্যাপার আছে। বাংলাদেশের জনগণ সাংঘাতিক রি-ধ্যাক্ট করে এটা মনে রাখবেন। সারা জীবন সাধনা করবেন, তারপর একটা অন্যায় করবেন, তার ফলেই মুছে যাবেন বাংলাদেশ থেকে । এইটেই বাংলাদেশের নিয়ম। সারা জীবন সাধনা করবেন, তারপর একটা অন্যায় করবেন, তারপর একটা অন্যায় করলে বাংলাদেশের মানুষ আপনাদের মুছে দেবে। আপনারা যারা যেখানে লোকালি থাকবেন, সেখানে পার্মানেন্টলি থাকতে হবে, কাজ করতে হবে, আযাডমিনিন্ট্রেশন চালাতে হবে।

দেখতে হবে, যে নতুন জিনিস আমরা করতে যাচ্ছি, তাতে আমরা সাকসেসফুল হতে পারি কিনা । বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। এ বিজ বিটুইন দ্য সাবকন্টিনেন্ট এন্ড সাউথইস্ট এশিয়া । অন্যান্য দেশ যতো বড়ই হোক না কেন, ভবিষ্যতে তারা আমাদের ফলো করবে, যদি আমাদের সিস্টেম সাকসেসফুল হয়। এটা মনে রাখা দরকার । আর তা যদি না হয়, ইতিহাস থেকে আপনারা মুছে যাবেন। আমাদের উদ্দেশ্য কি? কেন আপনারা রিস্ক নিয়েছিলেন? কেন স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিলেন। যাদের আজ আমি গভর্ণর করেছি, তারাআমার সাথে একত্রে কাজ করেছেন।

তাদের মনে রাখা দরকার যে ২৫/২৬ বৎসর আমার সাথে কাজ করেছেন। আপনারা বিন্রে করেননি, বেঈমানি করেননি । আপনারা আমাকে ছেড়ে সরকারি দলে যোগদান করেননি । আপনারা যুদ্ধের সময় শক্রর মোকাবিলা করেছেন। তারা আপনাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে । আপনারা সংসার ছেড়ে দিয়েছিলেন, আপনারা সবকিছু করেছেন। কেন করেছিলেন? নিজের জন্যঃ তা নয়। এ দেশের গরিব দুঃখীদের জন্য । যাতে একটা শৌষণমুক্ত সমাজ করতে পারেন- সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি করতে পারেন। যাতে বাংলার মানুষ সুখী হয়, ধলার মানুষ অত্যাচার-অবিচার থেকে বাচতে পারেন।

 

২১ জুলাই ১৯৭৫ ১ম সালের বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্ণরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
২১ জুলাই ১৯৭৫ ১ম সালের বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্ণরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

 

সেখানে যদি মানুষের উপর অত্যাচার না হয়, অবিচার না হয়, ঘুষ-দূর্ণীতি করতে পারেন, তাহলে আমাদের কাজের সুবিধা হবে। শুধু সরকারি অর্থে জনগণের মঙ্গল হয় না, উন্নতির কাজ হয় না। জনগণকে একতাবদ্ধ করতে হবে। আপনাদের জনগণকে মবিলাইজ করতে হবে। সেজন্য জনগণের মধ্যে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে হবে। সেই অনুপ্রেরণা সৃষ্টির দায়িত্ব থাকবে পার্টির এবং ত্যাডমিনিস্ট্রেশনের, গভর্ণরের, জয়েন্টলি। সরকার যদি দেন ৫০ হাজার টাকা, আপনারা কাজ করাবেন ৫ লাখ টাকার । বাংলার মানুষকে কোন কাজ করতে বললে তারা না বলে না।

বাংলার মানুষ যদি বোঝে যে, এই কাজে তাদের উন্নতি হয়, তবে তারা তাতে ঝাঁপিয়ে পড়বে । সেজন্য অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, যারা পার্লামেন্টের মেম্বার আগে ছিলেন, এখন নাই, তারাও আমার সাথে কাজ করেছেন। তাদের এবিলিটি সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট ধারণা থেকে ভালবাসা না পান, আপনাদের পরিষ্কার কথায় বলতে চাই যে, তারা যদি পপুলারিটি হারিয়ে ফেলেন_ তাহলে অসুবিধায় পড়বেন। আমার কিন্তু সাফ সাফ কথা । আমার কে কি করলো না করলো আমি কিছু শুনবো- টুনবো না। আপনার জায়গার মানুষ আপনাকে ভালবাসে কিনা, আমি সেটা দেখবো ।

যদি আপনার বিরুদ্ধে সেখানে গণবিক্ষোভ হয়, বাংলার জনগণ যদি দেখে যে আপনি ভাল কাজ করেছেন না, যদি আপনার সম্বন্ধে নেপোটিজম, করাপশনের অভিযোগ দেখা যায়, আমি কিছু শুনবো-টুনবো না। আপনাদের তো ধারণা আছে যে, আমি কোন কিছুতে হাত দিলে কিন্ত হাত উঠাই না। ওটা আমার নিয়ম নয়। হাত দেওয়ার আগে আমি বহুবার চিন্তা করি। কিন্ত একবার যদি হাত দিয়ে বসি- মাথা চলে যেতে পারে কিন্তু সে হাত আমার কমই উঠে। আমি আপনাদের যে নতুন সিস্টেম. দিয়েছি, এর মধ্যে আপনারা বেঁচে থাকবেন, আমিও বেঁচে থাকবো, বাংলাদেশ দুনিয়াতে বেঁচে থাকবে ।

অনেক অনুন্নত দেশ আপনাদের কাছ থেকে শিক্ষা নেবে- এখানে কি ব্যাপার হয়েছে। অত্যাচার-অবিচার আপনাদের এরিয়ার মধ্যে যাতে না হয়, তার জন্য আপনারা সেখানে ড্রাসটিক্যালি শাসন চালাবেন। ভাল করে কাজ আছেন আপনাদের সাহায্যের জন্য । যদি দরকার হয়, তাদের ডাকবেন। তারা বসবেন। বলবেন, আপনাদের সাহায্য করবেন। যদি দরকার হয়, আমার কাছে চলে আসবেন।

গণভবনে সোজাসুজি টেলিফোন থাকবে, আমার অফিসে থাকবে একটা । আপনারা যদি দেখেন যে, কোন জায়গায় কোন ডিপার্টমেন্ট আপনাদের সাথে কো-অপারেট করছে না, সোজাসুজি টেলিফোন করবেন। সেল থাকবে, অফিসার বসে থাকবেন, সিনিয়র অফিসার । খবর দিলে দেখবেন যে, সাথে সাথে কাজ শুরু হয়ে গেছে। এই ব্যবস্থা আমি আপনাদের জন্য করছি। আর একটা কথা । পার্টির সদস্য ছাড়া অন্য কেউ গভর্ণর হতে পারেন না এবং এখন পর্যন্ত খুব কম মানুষই পার্টির সদস্য পদ পেয়েছেন ।

যাদের আমি আজকে গভর্ণর করেছি, তাদের পার্টির মেম্বারশীপ দিয়ে এখানে আসতে, বসতে দেওয়া হয়েছে। তা না হলে তারা এখানে বসতে পারেন না। যেসব সরকারি কর্মচারী ভাইদের গভর্ণর করেছি, তাদের বেলায় এমনি কর্মচারীদের-যারা আমার চোখে ভালো । তারা সিনিয়র হন বা জুনিয়র হন, তাতে কিছু আসে যায় না। তাদের আমি গভর্ণর করেছি। পূর্ণ রেসপন্সসিবিলিটি তারা নিচ্ছেন। মনে রাখতে হবে- সরকারী কর্মচারীদের মধ্য থেকে যারা গভর্ণর হয়েছেন, তারা প্রিসাইডও করবেন।

পার্লামেন্টের মেম্বাও সেখানে বসবেন। তাহলে এই গভর্ণরদের পজিশন কোথায় উঠে গেল, সে কথা একবার চিন্তা করে দেখুন। দ্বিতীয়ত. যেখানে পার্টি কল করবে সেখানে গভর্ণরকে যেতে হবে, সেখানে বসতে হবে, আলোচনা করতে হবে। আপনারা এখন থেকে আর সরকারি কর্মচারী নন, পলিটিক্যাল পার্টি ওয়ার্কার-রিমেম্বার ইট- বাকশালের সদস্য । যেমন আমাদের পার্লামেন্টের মেম্বাররা বাকশালের সদস্য, তেমনি সরকারি কর্মচারীরাও বাকশালের সদস্য এবং সদস্য হিসেবে তাদের সেই পজিশনে সেখানে যেতে হবে এবং সেখানে কাজ করতে হবে । পার্লামেন্টের মেম্বার থাকবেন এঁ কাউন্সিলের সদস্য ।

আর্মি থেকেও একজনকে দিয়েছি। তাকেও মেম্বারশীপ দিয়ে খুলনায় গভর্ণর করেছি। এই রকম করে আমি সব জায়গা থেকে লোক এনে দেখতে চাই । এটা মনোপলি নয় আর যিনিই ফেল করবেন, চলে যাবেন, রাস্তা থেকে লোক ধরে এনে বসিয়ে দেবো। যিনি ভালো কাজ করবেন, তিনিই প্রশাসন চালাবেন। আর কোন কথা নাই। তবে, এটা একটা নতুন সিস্টেম। আর নতুন সিস্টেমে বাধা আছে। নতুন সিস্টেমের মধ্যে একটা ভয়ের সঞ্চার হয়। নতুন কিছু করতে গেলে একটা আশঙ্কা আসে । মানুষের মধ্যে দ্বিধা- সংশয় দেখা যায়। কিন্তু গত বিশ-পঁচিশ বছর আমি দেখেছি, ইংরেজ আমলের সিস্টেম- এ দেশে চলতে পারে না।

আজ আমি কেবল গোড়ায় হাত দিয়েছি। এখন ডিস্টিিক্ট করেছি। এক বছরের মধ্যে আমি থানায় যাচ্ছি। থানায় আমি আ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল করছি। থানায় যিনি হেড হবেন, তার নাম হবে থানা প্রশাসক । তিনি এমপি পারেন। সেখানেও হাই অফিসিয়াল থাকবেন। এইভাবে আ্যাডমিনিস্ট্রেশন চলবে। এমনি করে লোকাল প্রোগ্রাম, কালেকশন, সব কাজই চলবে, ভবিষ্যতে আরো অনেক কাজই করতে হতে পারে ।

এই যে আমাদের ডিস্টরিক্গুলো হয়েছে যখন আমরা সেগুলোর অবস্থা জানতে পারবো, তখন প্রোকিয়ারমেন্টের অবস্থা জানতে পারবো, ডিস্ট্রিবিউশনের অবস্থাও জানতে পারবো, তখন সেখানকার ফুল রেসপনসিবিলিটি তাদের নিতে হবে। ভবিষ্যতে সব কিছুর দায়িত্ব নিতে হবে। এ দায়িত্ব গভর্ণর সাহেবদের এবং আপনাদের কাউন্সিলের । যদি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হয়, সমস্ত দায়িত্ব হবে আপনাদের । যদি ফুড সিচুয়েশন খারাপ হয়, পুরো দায়িত্ব আপনাদের ।

 

২১ জুলাই ১৯৭৫ ১ম সালের বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্ণরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
২১ জুলাই ১৯৭৫ ১ম সালের বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্ণরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

 

যদি সেখানে দুর্ণীতি হয়, তা দমনের কর্তব্য আপনাদের । যদি সেখানে টেস্ট রিলিফের টাকা চুরি হয়, তাহলে তা বন্ধ করার ভারও আপনাদের । যদি ওয়ার্কস প্রোগ্রামের টাকা চুরি হয় তবে জনসাধারণের কাছে আপনাদেরই জবাব দিতে হবে। দেখুন কোথায় আছি আমরা। ফারটিলাইজার বাজারে বিক্রি হয় না। ফারটিলাইজার আমার সরকার থেকে দিই কিন্তু কোন বাজারে ফারটিলাইজার পাওয়া যায় না। আমাকে বুঝিয়ে বলুন, কোথা থেকে বাজারে যায়। গভর্ণমেন্ট গোডাউন থেকে যায়। আমরা গম আনি, গম বাজারে বিক্রি হয়। আমি ওয়ার্কস প্রোগ্রামে গম দিই, ফুড ফর ওয়ার্কে দিই।

এজন্য গমের ব্যাপার আমরা কিছু জাস্টিফাই করতে পারি। কিন্ত ফারটিলাইজারের ব্যাপারে জাস্টিফাই করি কি করে? আজকে সবদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রত্যেক ডিস্ট্রিক্ট যে টাকা যাবে, প্রত্যেক গভর্ণরকেই একটা রুমে তার চার্ট টাঙিয়ে রাখতে হবে বড় করে। পাবলিক যাতে দেখতে পারে । আমার টেস্ট রিলিফের টাকা আসছে, এই প্রোজেক্টে এইখানে খরচ হচ্ছে। এই ওয়ার্কস প্রোগ্রামে আসছে এখানে খরচ হচ্ছে । এই ফারটিলাইজার আসছে, এই জায়গায় গেল, অমুক ইউনিয়নের গেল। সব কিছুরই চার্ট টাঙিয়ে দিতে হবে। ডিস্ট্রিক্ট লোকদের জানাতে হবে।

সরকারের জিনিসপত্র কোন দিক দিয়ে আসে, কোন দিক দিয়ে যায়, কেউ জানে না। কত ফুড গেল ডিস্ট্রিক্ট, তা জানতে হবে। কোন থানায় কত গিয়েছে, কোন ইউনিয়নে কত গিয়েছে, তাও জানাতে হবে। এখন সমস্ত জাতিকে মবিলাইজ করতে হবে। তা না করতে পারলে কোন কাজ হবে না। আজ দায়িত্ব অত্যন্ত বেশি। আপনাদের যে টেকনিক্যাল ট্রেনিং আছে, সেগুলো কাজে লাগাতে হবে। বক্তৃতা করলে চলবে না। এখানে ত্যাডমিনিস্ট্রেশন করতে হবে । বুঝছেন, শিখতে হবে। শুধু অর্ডার দিলে হবে না। শুধু এটা করো, ওটা করো, এমন করলে হবে না। দেশে আইন-কানুন আছে।

আইন-কানুনের মধ্যে আপনারা বেআইনী কোন কাজ করবেন না। দেশের আইনের মধ্যে থাকতে হবে, তার মধ্যে অর্ডার করতে হবে। এই আইনগুলো পার্লামেন্টের শুধু একথা বললে হবে না। আপনাদের দেখে নিতে হবে, এই আইন এবং এই আপনাদের আ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ক্ষমতা । আপনাদের সাথে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন । তাদের এক্সপিরিয়েনস আছে। তারা ত্যাডমিনিস্ট্রেশন পরিচালনা করেছেন। তারা এ সমস্ত আইন-কানুন খুটিনাটি জানেন। আর, মনে রাখবেন, মিনিস্টার সাহেবরা আছেন, তারা অর্ডার করেন।

কিন্তু অর্ডার ইস্যু হয় সেক্রেটারির নামে, সেকশন অফিসারের নামে । এসব ভুলে গেলে চলবে না। আমরা অর্ডার করি, ডু দিস। সেটা এ জায়গায় ফাইলেই থাকে। এখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে সেক্রেটারী, জয়েন্ট সেক্রেটারী, ডেপুটি সেক্রেটারী, সেকশন অফিসার থেকে সমস্ত ডিপার্টমেন্টে ইস্যু হয়ে যায়। তেমনি করেই আপনারাও বলবেন। আপনাদের ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের যারা সেক্রেটারি, ডিস্টিক্ট ম্যাজিক্ট্রে, তাদের নামে ইস্যু হবে। আপনাদের অর্ডার আপনাদের ফাইলেই থাকবে । এই নিয়ম আছে।

আপনাদের কতকগুলো প্রটোকল মানতে হবে। সব কিছু আপনাদের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিদেশী লোক গেলে আপনারা কি করে . প্রটোকল করবেন? আপনাদের ফরেন পলিসি সম্বন্ধে ধারণা থাকা দরকার । আপনাদের রাষ্ট্রের কাঠামো সম্বন্ধে ধারণা থাকা দরকার, গ্যাডমিনিস্ট্রেশন সন্বন্বেও ধারণা থাকা দরকার । আর, বিচার ব্যবস্থা তাড়াতাড়ি বদলে ফেলা দরকার । বিচারের নামে অবিচার আর চলে না। এবার নতুন একটা কাঠামো করুন। সোজাসুজি বিচার হয়ে যাক। যাওয়ার সময়.একজন জামাইয়ের কাছে ব্রিফ দিয়ে যান, তার মরবার আগে পর্যন্ত মামলা চলতে থাকে ।

সাহেবরা এবার থানায় যান। থানায় গিয়ে ওকালতি করুন। আমার আপত্তি নাই- সব থানায় নিয়ে যান। থানায় মানুষ অতি সহজে নৌকা ভাড়া করে, পায়ে হেটে এসে বিচার পাবে। ডিস্ট্রিক্টে এসে, মানে সদরে এসে, বাংলার দুঃখী মানুষ কোন দিন বিচার পায় নাই। দেখুন গিয়ে, লোকে জেলের মধ্যে ফিফটি ফোর-এর আসামী হয়ে ছয় মাস, এক বছর পড়ে থাকে, কিন্তু তার পনের দিন জেল হয়। জীবনভর আমি জেল খেটেছি, কয়েদিদের সাথে জীবন কাটিয়েছি।

 

 

Bangabandhu Gurukul

 

 

আমি জানি তাদের কি দুঃখ, কি কষ্ট। বিচার হোক, জেল খাটুক। কিন্তু বিচার হয় না, হাজতে থাকে । ফিফটি ফোর এর এক বছর দুবছর হাজত খেটে এক মাস জেল হয়। আর এই যে এক বছর এগার মাস গেল, তার ক্ষতিপূরণটা কে দেয়। আবার অনেক সময় খালাসও হয়ে যায়। আমি এগুলোকে থানা লেভেলে নিয়ে যেতে চাই। পয়সাকড়ি আমাদের অভাব আছে, বুঝি আযাড মিনিস্ট্রেশন পয়সা কিছু কম খরচ করতে হবে। এখন, অনেকে আমাকে বলেন, আমাদের অফিস কোথায় হবে ।

 

২১ জুলাই ১৯৭৫ ২য় সালের বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্ণরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
২১ জুলাই ১৯৭৫ ২য় সালের বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্ণরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

 

গভর্ণর সাহেবরা আপনাদের নিজের নিজের এরিয়ার মধ্যে বাড়ি আছে। যারা সরকারি কর্মচারী আছেন, তাদের একটু হেল্প করবো আর আপনাদের বাড়িঘর ওখান থেকে যোগার করে নিতে হবে। মনে রাখবেন, আমরা দেবো, কিন্তু কিছু বাড়িঘর করে দেবো । কিন্তু নিজেদেরও যোগাড় করে নিতে হবে । আর যদি দরকার হয়, নিজে কুড়েঘরে থাকবেন। গ্রামে যান। আর এ ডাকবাংলো করবেন না। আগে ডাকবাংলো করা হতো, এখন তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছ। অবশ্য ডাকবাংলা উপকারে লাগে ।

কিন্তু এর মেইনটেন্স খরচ অনেক বেশি । আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি । যাই হোক, আগে যান । যেখানে যাবেন, সেখানে কিছু কিছু টিনের শেড করুন। টাকা কিছু কিছু আমরা রেখেছি দেওয়ার জন্য । টিনের শেড করে অফিসারদের জন্য কিছু বাড়ি, কিছু থানা, কিছু জেলখানা করতে হবে।

এগুলো আমরা করে দিচ্ছি, যত তাড়াতাড়ি হয় এবং সেটাও আপনাদেরই উপর চার্জ দিচ্ছি। রিমেম্বার, টাকা ভাগ করে স্কিম করে, সব দিয়ে দেয়া হবে। গভর্ণর সাহেবরা, আপনারা টেন্ডার কল করে তাড়াতাড়ি করে ঘর উঠিয়ে ফেলুন। অনলি ইঞ্জিনিয়ার যাবেন। যদি দরকার হয়, পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ার থাকবেন, হাই ওয়েজের ইঞ্জিনিয়ার থাকবেন। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবরা, গভর্ণর এবং ডিস্টটিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, এই পাঁচজনকে দিয়ে আমরা কমিটি করে দেবো এবং টাকা তাদের হাতে দেবো । সেই টাকা আমরা তাদের কাছে দিয়ে, তাদের স্থবিম করে দেবো । সেই টাকা দিয়ে কাটছাট করে কিছু অফিস, কিছু টিনশেড ঘর-বাড়ি তাড়াতাড়ি করে নিতে হবে।

যেখানে যা কিছু পাওয়া যায়, ভাগ করে থাকবেন। এক কামরা, দু’কামরা যা পাওয়া যায়, তাতে থাকবেন। এ-দেশের মানুষ না খেয়ে মারা যায়। এখানে অত ফ্যাশনের কি দরকার! আপনারা ঠিকভাবে কাজ করুন। অন্যান্য বিষয়ের ব্যবস্থা করবার জন্য আমি সমস্ত মিনিস্টার সাহেবদের অনুরোধ করেছি। ভাইস-প্রেসিডেন্ট সাহেবদের অনুরোধ করেছি। পলযানিংয়ের ব্যাপারে । প্রাইম মিনিস্টার সাহেবকেও অনুরোধ করেছি। তিনিও বলবেন।

আর এই যে- আমি আপনাদের জন্য ম্যাপ করে এনেছি। দেখেছেন? অলরেডি ম্যাপ করা হয়ে গেছে। বুঝতেই পারছেন, এক একটা এরিয়ায় বা পপুলেশন তাতে দেখা যায় যে, অনেক দেশ-অনেকে বলতে পারেন, যারা খবর রাখেন, তারা বলতে পারেন যে, ২০ লাখ, ৩০ লাখ লোকের দেশ, শ খানেক দুনিয়ায় হবেই। আমাদেরও ১০ লাখ, ২০ লাখ, ৩০ লাখ লোকের দেশ, আপনারা এক-একজন তার বাদশার মতো । অফ কোর্স ইউ আর নট বাদশাহ, আপনারা খাদেম ।

সমস্ত জেলা ভাগ করে দেয়া হয়েছে। শুধু একটার মধ্যে আমাকে চেঞ্জ করতে হবে। বান্দরবান এরিয়ার একটা থানা কক্সবাজারে নিয়ে যেতে হবে । আর সব দেখে ম্যাপ করা হয়েছে। এ্যডজাষ্টম্যান্ট, রি-এ্যডজাষ্টমেন্ট করতে হবে। তার জন্য কমিটি করে দেয়া হয়েছে। সেখানে দেখবেন, কোথায় কি আাডজাস্টমেন্ট রি-আযাডজাস্টমেন্টের দরকার হয় । এখন আমি সরকারি কর্মচারীদের আর একটি কথা বলবো।

যদিও আপনারা সরকারি কর্মচারী, আপনারা গভর্ণর হয়েছেন। সেখানে পার্লামেন্টের মেম্বার থাকবেন। সকলে মিলেমিশে কাজ করতে হবে । এখন থেকে সবাই গভর্ণমেন্টের চাকরি করবেন, সাথে সাথে পার্টি মেম্বারও থাকবেন। পার্টি মেম্বার ক্লোজ, গভর্ণর শীপ ক্লোজ, এভরিথিং ক্লোজ। বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা । সব কাধের উপর চাপিয়ে দেবো । যাতে খালি বক্তৃতা না করেন, এরপর থানায় থানায় দেবো । বলবো কাজ করুন।

ফেল করলেন-ব্যস খতম । আমি গিয়ে বক্তৃতা করে আসবো, উনি কাজ করতে পারেন না, ওকে বিদায় করে দাও । লোকে তাই করে দেবে। হ্যা, এইভাবে কাজ করতে হবে। মোট কথা, এই শাসন ব্যবস্থা হয়েছে জনগণের মঙ্গলের জন্য । জনগণ যাতে সোজাসুজি শাসন ব্যবস্থার ফল ভোগ করতে পারে, তার জন্যই এই সিস্টেম করা হয়েছে । সোজা কথায়, কোনরকম অসুবিধা যেন তাদের ভোগ করতে না হয়।

সব কিছুই যেন জনগণের সামনে নিয়ে যাওয়া হয় ইডেন বিল্ডিংস বা গণভবনের মধ্যে । আমি শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা রাখতে চাই না। আমি আস্তে আস্তে, গ্রামে, থানায়, ইউনিয়নে, জেলা পর্যায়ে এটা পৌছে দিতে চাই। যাতে জনগণ সরাসরি এসবের সুযোগ-সুবিধা পায় । বড় জিনিস হলো, একটা লাস্ট কথা, যেটা আমি বার বার বলি- করাপশন। আমি আমার সহকর্মীদের ভেতর থেকে যাদের দিচ্ছি এবং এ পর্যন্ত আমি গভর্ণর করেছি, তাদের প্রতি- সরকারি কর্মচারী থেকে আর্ত করে, সকলের প্রতি আমার আস্থা আছে। আমি বিশ্বাস করি যে, তারা করাপশনের উধ্র্বে থাকবেন। কিন্তু শুধু নিজেরা ঘৃষ খাওয়াই করাপশন নয় ।

এ সম্বন্ধে আমার কথা হলো করাপ্ট পিপলকে সাহায্য করাও করাপশন। নেপোটিজমও কিন্তু এ টাইপ অফ করাপশন। স্বজনগ্রীতিও কিন্তু করাপশন। আপনারা এসব বন্ধ করেন। কোন ভয় নাই, কোন ভয় নাই। কারো ভয় নাই। আল্লাহ ছাড়া কারো ভয় করবেন না। আমিও আপনাদের সাথেই আছি। 04 স্বজনগ্রীতি ছেড়ে দিলে আপনারা করাপশন বন্ধ করতে পারবেন । যারা থানা এ্যাডমিনিস্ট্েশনে রয়েছেন, তারা সেখানে করাপশণ বন্ধ করবেন। সেখানে অনেক জিনিসের ডিস্ট্রিবিউশন হয়, সব কিছুর ডিস্ট্রিবিউশন হয় থানা লেভেলে, ডিস্ট্রিক্ট লেভেলে ।

এসব জায়গায় যদি করাপশন বন্ধ করতে পারেন, তাহলে উপরের করাপশন অটোমেটিক্যালি বন্ধ হয়ে যাবে। এটার উপর সোজা নজর দেবেন। প্রত্যেকে নজর দেবেন । আর, আজ আমার কাছে আপনারা তওবা করে যান যে, স্বজনগ্রীতি করবেন না। ঘুষখোরদের সাহায্য করবেন না। মাত্র কয়েকটা লোকের জন্যই বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ দূর করা যায় না- আমি এর প্রতিকার দেখতে চাই। এর জন্য আপনাদের কাছে অনুরোধ রইলো। আর, আমার কর্মী যারা আছেন, যারা আমার কথায় বন্দুক ধরে যুদ্ধ করেছিলেন, যারা আমার কথায় মাতৃভূমি ত্যাগ করে বিদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

 

২১ জুলাই ১৯৭৫ ২য় সালের বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্ণরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
২১ জুলাই ১৯৭৫ ২য় সালের বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্ণরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

 

যারা আমার কথায় সব কিছু ত্যাগ করতে পারতেন, তারা আমার একটা কথা রাখুন_ঘুষ দুর্নীতি বন্ধ করুন, আপনাদের এরিয়াতে যেয়ে দেখুন, বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ দূর হয় কিনা । তারা না খেলেও কথা বলবে না। যদি তারা দেখে যে, তাদের সামনের খাবার অন্যে না খায়। যদি তাদের বোঝানো যায় যে, না আমার নাই, তাহলে তারা দুঃখ করবে না। তারা যখন দেখে যে, তাদের জন্য যে আটা পাঠানো হচ্ছে, তা অন্যে চুরি করে খায়, তাহলে তাদের দুঃখের জায়গা থাকে না। তখন তারা অভিশাপ দেয়। সে অভিশাপ আপনাদের লাগে কিনা জানি না। কিন্তু আমার লাগে। কারণ, তারা আমায় দোয়া করেছে।

এ দেশের মা-বোনেরা যদি আমার জন্য রোজা না রাখতো, মসজিদে মন্দিরে যদি দোয়া না করতো, তাহলে বোধহয় আমি ফিরে নাও আসতে পারতাম । লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষ রোজা রেখেছে আমার জন্য মাসের পর মাস। মাঝে মাঝে আমার অসহ্য লাগে, যখন ভাবি, কেন এই করাপশন সমাজের মধ্যে ঢুকেছে? এখন অনেকে এগিয়ে আসছে । আপনারা ইচ্ছা করলে নিজের নিজের এরিয়ার মধ্যে করাপশন বন্ধ করতে পারেন । আমি বিশ্বাস করি, আপনারা পারবেন। অন্য কাজ করুন বা না করুন- এটা করবেন । দূর্ণীতি যেন আর না থাকে । আর একটা কথা আমি আজ আপনাদের বলে দিতে চাই।

থানায় এসে যেন মানুষ বসতে পারে, তাদের যেন পয়সা দিতে না হয়। সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে এলে তাদের যেন পয়সা দিতে না হয়। সিও অফিসে যেন পয়সা দিতে না হয়। কোর্টে এলে যেন পয়সা না দিতে হয় এবং তাদের যেন হয়রানি না হয়। যিনি যেখানে থাকবেন, সেখানকার পুলিশ তার আন্ডারে থাকবে । যে রক্ষীবাহিনী সেখানে থাকবে, তা তার আন্ডারে থাকবে । এমনকি, যে আর্মি সেখানে পোস্টিং আছে, সেই আর্মি তার আন্ডারে থাকবে- এ মুহুর্তে এ জায়গায় । অফ কোর্স, তাদের নিজ নিজ কমান্ড আছে। কিন্তু আপনারা যা বলবেন, তা তাদের শুনতে হবে।

আপনাদের কর্তব্য আছে অনেক। করাপশন বন্ধ করুন, আল্লাহর দোহাই, করাপশন বন্ধ করবার চেষ্টা করুন। আপনাদের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে । আপনারা পারবেন । আপনারা লোকালি ঘুরতে থাকুন। আপনারা নৌকায় ঘুরুন, গাড়ি নিয়ে ঘুরুন- মানুষ যাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারে । যে থানায় চুরি-ডাকাতি কমবে না, সেখানকার লোক ডেকে কনফারেন্স করে বলুন- চুরি ডাকাতি তোমাদের এরিয়ার বন্ধ করতে না পারলে তোমরা বিদায় হবে। সাফ সাফ কথা । রেসপনসিবিলিটি নিতে হবে । তোমরা যারা এখানে আছো, তাদেরই এসব বন্ধ করতে হবে।

চুরি, ডাকাতি, ঘুষ, দুর্ণীতি বন্ধ করতে হবে- এটা ভালো করে জানবেন। সাবধান, আপনাদের সবাইকে আমি এসব বলে রাখছি এখানে । যারা এখানে আছেন, তাদের সবাইকে সাবধান করে রাখছি। আমি এ ব্যাপারে সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়েছি। ভাবছি, কি করে এগুলো দূর করা যাবে। আমি একটা কাজের কথা বলি- দুই বছর আগে, আর এক বছর পরে তাতে হাত দিই । রিমেম্বার ইট । আপনারা জানেন, আমাকে ভালো করেই জানেন। আপনাদের কাছে আমার কথা রইল, যাদের আমি গভর্ণর করেছি- তারা করাপশন বন্ধ করুন। ৃ ৃ ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্ক, ফ্যামিলি প্ল্যানিং আর আমার দ্বিতীয় বিপ্লবের যে চারটি প্রোগ্রাম আছে- সেগুলো আপনারা করুন।

ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কের জন্য পাম্প পেলাম না, এটা পেলাম না- এসব বলে না থেকে জনগণকে মবিলাইজ করুন। যেখানে খাল কাটলে পানি হবে, সেখানে সেচের পানি দিন। সেই পানি দিয়ে ফসল ফলান। মবিলাইজ দি পিপল। পাম্প যদি পাওয়া যায়, ভালো। যদি না পাওয়া যায়, করে স্বনির্ভর হন। বাধ বেধে পানি আটকান, সেই পানি দিয়ে ফসল ফলান। আমাদের দেশে কি পাম্প ছিল? দরকার হয়, কুয়া কেটে পানি আনুন। আমাদের দেশে পাচ হাত সাত হাত, আট হাত কুয়া কাটলেই পানি উঠে ।

সেখানে অসুবিধা কি আছে? যে দেশে পানি আটকে রাখলে পানি থাকে, সেখানে ফসল করবার জন্য চিন্তার কি আছে? আর, এখন থেকে যে সমস্ত সার থানায় যাবে, তা যেন রেগুলারলি গরিব-দুঃখীরা পায়। আর একটি কথা । মাথা যেন গরম না থাকে। সাবধান, মাথা গরম করে শাসন করা যায় না। মাথা গরম না করে কাজ করতে হবে। আর সংযম ও সহনশীলতা যেন থাকে । সংযম ও সহনশীলতা না থাকলে কোন কিছুই করতে পারবেন না এবং যে কোন ডিসিশন নিতে চিন্তা-ভাবনা করে, পরামর্শ করে করবেন। যেটা ভালো মনে করবেন, সেটা করবেন।

চিন্তা ভাবনা করে। হঠাৎ কিছু করবেন না। হঠাৎ করলে কিন্তু মানুষের ভুল হয়। চিন্তা-ভাবনা করে ডিসিশন নিয়ে যদি মনে করেন- এটা ভালো, তাহলে স্টিক করবেন। স্কুল-কলেজ আছে, সেখানে গভর্ণমেন্ট টাকা দেয়। প্রাইমারী স্কুলে আমরা টাকা-দিয়েছি। অনেকে স্কুল করে না, অনেকে পড়ায় না, স্কুলেও যায় না। সেখানে লোকে গরু-ছাগল বেঁধে রাখে । টাকাও পায়, আবার রেশনও দিই- সেগুলো ওয়াচ করবেন। আপনি না পারেন, আপনার একজন অফিসার পাঠিয়ে দেবেন।

ডিস্ট্রিক্ট অফিসার, স্কুল অফিসার, এই সমস্তকে কক্ট্রোলে নিয়ে আসুন। এ সম্বন্ধে খোজ নিয়ে আসুন । যদি দেখেন কোন টিচার কাজ করছেন না, তাকে বদলি করে দিন। তারা সরকারি কর্মচারী এখন। টাকা যা পাঠানো হয়, খেয়ে ফেলেন। সাবধান দুর্ণীতি বন্ধ করতে হবে। যত ডিপার্টমেন্ট আছে, সবগুলোর ব্রাঞ্চ সব ডিস্ট্রিকে থাকবে । ওভারওল রেসপনসিবিলিটি আপনাদের । ইনফরমেশন ডিপাটমেন্ট রয়েছে। বাংলাদেশে এখানে বসে যে কাজ হয়, পাবলিসিটি এই ডিপার্টমেন্ট দেয়।

প্রত্যেক ডিস্ট্রিক্ট, সাব ডিভিশনে এর ব্রাঞ্চ আছ। আল্লাহ্‌র মর্জি সেখানকার লোক কয়েকখানা কাগজ দরজায় লাগিয়ে দিয়ে ঘরের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকেন আর বাকি সব সের দরে বিক্রি করে দেন। তার কাছে খোজ নিতে হবে, কত কাগজ এলো । গ্রামে গ্রামে যান, পাবলিসিটি করুন। আর একটি জিনিস মনে রাখতে হবে। এই নতুন সিস্টেম করলাম কেন? কোন ডিপার্টমেন্ট কাউকে মানতে চাইত না। আমি অমুক, আমি ফুড, আমি এগ্রিকালচার, আমি হেলথ, আমি ফ্যামিলি প্ল্যানিং, আমি এটা, আমি ওটা । এসডিও সাহেব, ডিসি সাহেব যতদূর পারতেন করতেন।

না পারতেন না করতেন। কিন্ত সকলেরই সকল বিষয়ে কর্তব্য আছে। একথা সকলেরই মনে রাখা দরকার | যদি গভর্ণর বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বলেন- এই অফিসারের এই কাজ, তাহলে সেই অফিসারকে সে কাজ করতে হবে । যিনি ফুড ডিপার্টমেন্টের, অফিসার, তাকে সে কাজ করতে হবে । তিনি এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্টের অফিসার হলেও এ-কাজ করতে হবে । আমার কাজ ওটা নয়- এ কথা বললে চলবে না। রাস্তার উপর একটা বাশ পড়ে আছে। সেটা কেউ উঠাবেন না । বলবেন, এ কাজ আমার নয়- এটা রোড এন্ড হাইওয়েজের। হাত দিয়ে কেউ বাশটা তুলবেন না।

এ হয়েছে দেশের গভর্ণমেন্টের সবচেয়ে বড় অসুবিধা। এটা আমার নয়, অমুক ডিপার্টমেন্টের । দ্যাট নুইসেল মাস্ট স্টপ ইন দিস কানট্রি। সকলেরই সকল কাজে রেসপনসিবিলিটি আছে। সবাই বাংলাদেশের নাগরিক, বাংলাদেশ সরকারের চাকরি করে । আপনাদের কর্তব্য, যেখানে অন্যায় বা খারাপ কাজ হয়, সেটা দেখতে হবে । যার কাজ তাকে ডেকে বলুন। কিন্তু খবরই দেয় না কেউ। মাল এখানে সেখানে পড়ে থাকে । তেজগাও এয়ারপোর্টের কাছে মাল পড়ে ছিল। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের কাছে মাল পড়ে ছিল। কিছু মাল পড়েছিল অন্যান্য জায়গায় । এটা কার? এটা আমার নয়, টিএন্ডটির।

 

২১ জুলাই ১৯৭৫ ২য় সালের বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্ণরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
২১ জুলাই ১৯৭৫ ২য় সালের বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্ণরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

 

এটা কার? এটা আমার নয়, সিন্ডবির। আমি বললাম, এসব কথা আমি বুঝি না।” আগামীকালের মধ্যেই সব মাল পরিস্কার করে নেওয়া হোক। এটা ঢাকা শহরে দেখেছি। ডিস্ট্রিক্ট এডমিনিস্ট্রেশকে দেখতে হবে, কোথায় কি আছে, না আছে। আমার ঢাকা মেন্রোপলিটনে বাস করি। আর কয়দিন পর ঢাকা শহর থাকবে কিনা, ভাবার কথা । টিন্ডটির রাস্তা কেটে যায়, গ্যাস রাস্তা কেটে যায়, ওয়াসা রাস্তা কেটে যায়। রাস্তার জান শেষ। প্ল্যান ওয়েতে কাজ হচ্ছে না। আর একটা কথা । “কো-অর্ডিনেশন। ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড নাউ, আপনাদের রেসপনসিবিলিটি আর ক্ষমতা কতখানি ।

আমি চারটি কথা বলেছি সেকেন্ড রেভূল্যুশনের জন্য । আশা করি সকলের মনে আছে। এগুলো সামনে রেখে কাজ করবেন। বক্তৃতা যা করি, মেহেরবানি করে পড় ন, যেগুলো পলিসি বক্তৃতা করেছি। আজ বক্তৃতা করিনি, আজ আপনাদের ট্রেনিংয়ের ভিষণ আলোচনা করছি। আপনাদের ট্রেনিং কোর্সের উপর বললাম আপনারা কি কি শিখে যাবেন, এর অর্থ কি, উদ্দেশ্য কি, কেন অন্য মিনিস্টার এটা বললেন, এসব বুঝতে হবে। প্ল্যানিং থেকে কাগজপত্র নিতে হবে। দ্বিতীয় কথা, আমাদের একটা ন্যাশনাল প্ল্যানিং আছে। সে সমন্ধে ভাইস প্রেসিডেন্ট কাল বলবেন। ন্যাশনাল প্ল্যানিং একটা হবে ।

কিন্তু লোকালি হ্যাপহ্যাজার্ড ওয়েতে কাজ করা হয়। আগে দেখেছি, ওয়ার্কস প্রোগ্রামে মাটি কাটার দরূণ পানি বন্ধ হবার ফলে জমি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ওটা আমরা বন্ধ করেছি। এখন লোকালি বসে আমাদের প্ল্যান করতে হবে। আপনারা নিজেরা কামড়া-কামড়ি করবেন না। এটা একটি ফ্যাশন হয়ে দীড়িয়েছে। ডিস্ট্রিক্ট পাচজন বা ছয়জন এমপি আছেন, চারটি থানা আছে। কেউ বলবেন, আমার থানায় এটা হোক, কেউ বলবেন, আমার ওটা হোক- এভাবে কাজ হয় না।

এই প্রোজেক্টটি ভালো, এই বছর হোক, নেক্সট প্রজেক্ট ওই বছর হোক, তার পরের প্রোজেক্টটি অন্য জায়গায় করুন। এই ভাবে আস্তে আস্তে করুন। ভাগ করে করে প্ল্যান নষ্ট করবেন না। এখানে এই জিনিসটা ভালো হবে, এটা করলে এতো হাজার একর জমিতে ফসল ভালো হয়, এই খালটা আমি করবো । এখানে এই রাস্তাটা করলে ভালো হয়। এটা করবো। এখানে এই পুকুরটা খনন করলে ভালো হয়, এটা আমরা করবো । এইভাবে কাজ করতে হবে।

সবাই যখন কনফারেন্সে বসবেন, তখন কেউ বলবেন না যে, আমার থানায় কত দিলেন। আগেই সবাই প্রোজেক্ট নিয়ে আসবেন, কাজ করবেন। তারপর যা দেওয়ার দিবেন। প্রথমে দেখবেন, কোনটাতে মানুষের উপকার বেশী হবে। সেটা আগে করবেন। আজ এখানে হোক, কাল ওখানে হোক। এভাবে করলে পাঁচ বছরে সব জায়গায় হয়ে যাবে। অসুবিধার কিছু নাই। দুটো করে প্রোজেক্ট করুন। মানুষ দেখুক, বুঝুক। এটা ভুললে চলবে না আপনাদের । সেজন্য আপনারা নিজেরা আপনাদের ছোট ছোট প্ল্যান রাখুন, এবং সেই অনুযায়ী কাজ করুন| আপনাদের কাছে ওয়ার্কস প্রোগ্রাম যাবে, টেস্ট রিলিফ যাবে, ফুড ফর ওয়ার্ক যাবে ।

এসবের জন্য প্রোজেক্ট করে রাখবেন । এছাড়া কোন প্রোজেক্ট ভালো হলো, তা দেখবেন- ওয়ার্কসে পাঠিয়ে দেবেন। পাওয়ারের দরকার যেখানে আছে, তার প্ল্যান করে সেটা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেবেন। আমি খবর পেলাম, ঠাকুরগীয়ে একটা কোল্ড স্টোরেজ করা হয়েছে। এক বছর আগে সেটা হয়ে গেছে। কিন্তু পাওয়ার নাই। খবর নিয়ে জানলাম, পাওয়ার সেখানে যেতে এক বছর লাগবে । কারণ, খাস্বা নাই। খাম্বা নাকি বিদেশ থেকে আনতে হবে । মিনিস্টার সাহেবকে বললাম, খাস্বা- টাম্বা অমি বুঝি না, বাশ তো আছে। এখানে দীড়াও খাম্বা কাটো, দা লাগাও । দেড় মাস, দুই মাসের মধ্যে কাজ হয়ে যাবে । এটা লাগাও ।

কি করে লাগবে, সেটা আমি বুঝি টুঝি না। দিল, লেগে গেল। কিন্তু আমার কাছে যদি না আসত, এক বছরের আগে খাম্বা পেত না, এটা হত না। খাম্বা আসে কোথেক। পাওয়ার গেল, আলু রাখল । আলু রাখার জায়গা নাই। এই মেন্টালিটি কেন হয়? খাম্বা বাংলাদেশের গাছে গাছে হয়। আমি বাংলাদেশে প্রতিটি থানায় পাওয়ার দিতে চাই । কো-অপারেটিভও আমি প্রতিটি গ্রামে করতে চাই। এটা সোজাসুজি বাঙালি কো-অপারেটিভ। যাকে বলা হয় মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ । কো-অপারেটিভ ডিপার্টমেন্ট আছে, থাক। ওটা চলুক। আমি এটার নাম দিয়েছি স্পেশাল কো-অপারেটিভ। এর জন্য ১০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।

এর জন্য আমার একটা টার্গেট রয়েছে। আপনারা ৬১ জন গভর্ণর যখন চার্জ নিয়ে যাবেন, দুই তিন মাসের মধ্যে জায়গা ঠিক করে, একটা ভিলেইজ ঠিক করে সব ব্যবস্থা করবেন। আমি এখন প্রোগ্রাম করছি । আমি নিজে ঠিক করছি আমার পদ্ধতি । যেটা করে এক একটা ডিস্ট্রিক্টে একটা করে কো-অপারেটিভ করতে হবে। সেটা হবে মাল্টিপারপাস কো- অপারেটিভ।

প্রথমে এরিয়া ভাগ করে নেবেন। এমন জায়গায় নেবেন, যেখানে আমি ইমিডিয়েটলি পাওয়ার দিতে পারি। এ কো-অপারেটিভগুলোকে আমি পাওয়ার দেবো । ধরুন, যদি রাজশাহীতে করি, তাহলে এমন জায়গায় করতে হবে, যেখানে পাওয়ার নিতে পারি। যদি নাটোরে করি, তাহলে এমন জায়গায় করতে হবে যেন সেখানে পাওয়ার নিতে পারি। এভাবে একটা দুটো, তিনটে গ্রাম নিয়ে কো-অপারেটিভ করতে হবে এবং এটা হবে কম্পালসারি কো-অপারেটিভ এতে কোন কিন্তু-টিন্ত নাই।

তারপর সিস্টেম যা হবে, সবাইকে তা বলে দিতে হবে। এটাকে সাকসেসফুল করতে হবে। এটাকে পুরাপুরি সাকসেসফুল করতে হবে_ এটা স্পেশাল কো-অপারেটিভ নামে পুরাপুরি করতে হবে। তারপর আমার সেন্ট্রাল কমিটির মেম্বারদের সুপারভিশনে একটা কো-অপারেটিভ করবো। তারা সেখানে সুপারভাইজ করবেন। একটা করে স্যাম্পল করে আমরা অগ্রসর হবো । ইনশাল্লাহ তারপর আর কোন অসুবিধা হবে না। একবার যদি একটা ডিস্ট্রিক্টে একটা কো-অপারেটিভ এ মানুষ দেখে যে এই দেশের মানুষের এই উপকার হয়েছে, তাহলে আপনাদের আর কষ্ট করতে হবে না।

তারা নিজেরাই এসে বলবে, আমাদের এটা করে দাও, আমাদের করে দাও, আমাদের করে দাও । আর আমাদের আইডিয়া হলো, একটা ট্রেনিং কোর্স, ট্রেনিং সেন্টার করুন। শেখে বই পড়ে ট্রেনিং হয় না। হলেও খুব কম হয়। কেউ করে শেখে, কেউ দেখে শেখে আর কেউ বই পড়ে শেখে । আর সবচেয়ে যে বেশি শেখে-.সে করে শেখে । আপনারা করে শিখবেন। কাজ করে দেখিয়ে দিন, কিভাবে কাজ করতে হয়। বই পড়ে আমাদের একটা ফ্যাশন হয়েছে। ট্রেনিং সেন্টার করুন। কো-অপারেটিভ ট্রেনিং সেন্টার করে সেখানে সবাইকে নিয়ে যান। এক মাস এখানে ট্রেনিং হবে।

সেখানে পেনশন খাইয়ে কি হবে? কি করবেন সেখানে? লেকচার? পাট গাছে ধান হয় না, ধান গাছে পাট হয় না। বাংলাদেশের মানুষ এটা ভালোই বোঝে । তামাকে বৃষ্টি পড়লে তামাক নষ্ট হয়, তাও বোঝে । রবিশস্য কেমন করে হয় তাও বোঝে । আমরা অনেক লোক এখানে আছি। অমাদের কোন জনগণ ধান- আম-পাট বেঁচে, মরিচ-পেয়াজ বেঁচে লেখাপড়া শেখিনি-এই যাদের গভর্ণর করেছি, তাদের মধ্যে কে ধান-পাট বেঁচে, মরিচ পেয়াজ বেচে লেখাপড়া শেখেনননি। আপনাদের প্র্যাকটিক্রাল নলেজ নাই। খালে ডুবে গোসল করেছি আমরা । নদী সাতরে পার হয়েছি। কত কি গ্রামে করেছি। কি জানেন না।

তবে, হ্যা, একটা সিস্টেম শিখাবার জন্য কোর্স আমরা দিচ্ছি। এই জন্য যে এ্যাডমিনিস্ট্রেশন শিখতে হবে আপনাদের কাগজে কলমে । কাজের জন্য আসতে হবে ময়দানে । আপনাদের কাজ করে শিখতে হবে । সেই জন্য আমার কো-অপারেটিভ। যদি কাজ করে শিখতে চান, যদি ভবিষ্যৎ অন্ধকার করতে না চান, তাহলে আমার কো-অপারেটিভ সাকসেসফুল করুন। আপনারা আমার কথা জীবনভর শুনেছেন। আজো শুনুন। দূর্ণীতির উধ্র্বে থেকে দেশের জন্য কাজ করুন। সিস্টেমটাকে আমাদের সাকসেসফুল করতেই হবে ।

আমি অনেক ভালো অফিসার দিয়েছি। যদি দিয়েছি। বিশ্বাস করি, তারা ভালো কাজ করবেন। এ সম্বন্ধে আমার কোন সন্দেহ নাই। এতে কিন্তু একটা কমপিটিশন আছে। এই সিস্টেমে গভর্ণমেন্ট এমপি আছেন, নন-এমপি আছেন। কমপিটিশানও কিন্ত একটা আছে। এমপি আছেন, নন-এমপি আছেন, সরকারি কর্মচারী আছেন, আর্মি অফিসার আছেন, কমপিটিশন ভালো হবে। যাই হোক, তার জন্য একটা কথা মনে রাখতে হবে । সাফ কথা বলে দিলাম, বি কেয়ারফুল। আপনারা কিন্ত সবাই এক।

 

Bangabandhu Gurukul

 

আরও পরুন :

Leave a Comment