[ADINSERTER AMP] [ADINSERTER AMP]

২ জুন ১৯৭৩ । জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

২ জুন ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণঃ শনিবার, বিকার ৩-০৪ মিনিটে স্পীকার মুহম্মদউল্লাহর সভাপতিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশনের প্রথম বৈঠক শোক প্রস্তাব জনাব স্পীকার ৪ এখন শোক-প্রস্তাব। আমি অত্যন্ত দুখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, জনাব এ এফ এম নূরুল হক হাওলাদার (১৭ঃ ফরিদপুর-১৭) ৩০ মে বুধবার দিবাগত রাত্রে ফরিদপুর জেলার নড়িয়া থানার অন্তর্গত সলতা গ্রামে নিজ বাসভবনে জনৈক আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর অর্থাৎ এম এ পাস করেন। ১৯৫২ সালে রাষট্রভাষা-আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।

 

২ জুন ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
২ জুন ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

 

২ জুন ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

 

ছাত্র আন্দোলনের সাথে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৫৪ সালে তিনি যুক্তফ্ন্টের নির্বাচনী কার্যে ছাত্রক্মীদের নেতৃত্দান করেন। ১৯৬২ সালে তিনি তৎকালীন শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল করার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং তথাকথিত পাকিস্তানী সংবিধানের বিরোধিতা করায় মরহুম শহীদ হোসেন সোহরাওয়ার্দী যখন কারারুদ্ধ হন, তীকে মুক্ত করবার আন্দোলনেও ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সেমিনারে তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

ছাত্রদের ১১-দফার আন্দোলনের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও নেতৃত্দান করায় তীকে একাধিক মামলায় জড়ানো হয় এবং ই পি আর বাহিনীর হাতে অশেষ নির্যাতন ভোগ করতে হয়। ১৯৬৯ সালে তিনি ডিঙ্গামানিক ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি এবং নড়িয়া থানা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি হন এবং আওয়ামীলীগের সুগ্রীম কাউন্সিলের অধিবেশনে কাউল্সিলার হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।

১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তিনি নির্বাচনী এলাকা ফরিদপুর-১৭ থেকে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হন। জনাব হাওলাদার সাহেবের অকাল মৃত্যুতে বাংলাদেশ তার একজন সংগ্রামী জননেতা এবং অক্রান্ত সমাজকর্মীকে হারাল । আমি আশা করি, এই স্রংসদ সর্বসম্মতিক্রমে নিম্নের প্রস্তাবটি গ্রহণ করবেন এবং অনুমোদনের পর প্রস্তাবের একটি অনুলিপি মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবারের নিকট প্রেরণ করা যেতে পারে।

“এই সংসদ গভীর দুঃখ ও সমবেদনার সহিত প্রস্তাব করিতেছে যে, জাতীয় সংসদ-সদস্য জনাব এ এফ এম নূরুল হক হাওলাদারের অকাল মৃত্যুতে বাংলাদেশ ইহার একজন সুসন্তান, অক্লান্ত সমাজকর্মী এবং সংগ্রাম ও জনপ্রিয় নেতা হারাইয়াছে। এই সংসদ মরহুমের আত্মার সদগতি কামনা করিতেছে।” বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (প্রধানমন্ত্রী, পরিষদ নেতা) : জনাব স্পীকার সাহেব, এই অধিবেশনে বসার আগে এবং ইতিপূর্বে আমাদের কয়েকজন সহকর্মীকে আমরা হারিয়েছি। আজ নূরুল হককে হারালাম । তিনি যুবক ছিলেন। নিরস্বার্থ কর্মী ছিলেন।

 

২ জুন ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
২ জুন ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

 

মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা যোগদান করেছিলেন, তাদের আন্দোলনের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। আমি তাকে অত্যন্ত গ্নেহ করতাম, অত্যন্ত ভালবাসতাম- নিঃস্বার্থ কর্মী বলে। এম এ পাস করে সাধারণত মানুষ শহরমুখো হয়ে যায়। নূরুল হক কিন্তু শহরমুখো হননি, শহরে থাকেননি, গ্রামেই থাকতেন। গ্রামের লোককে ভালবাসতেন । গ্রামের মানুষের পাশে পাশে তিনি থাকতেন। অধিকাংশ মানুষের কাছে কাছে থেকে তাদের দুঃখ কষ্টের দিকে লক্ষ্য রাখতেন । শহর ছেড়ে গ্রামে থাকা একটা বড় জিনিস। গ্রামের মানুষের খোজ-খবর তিনি নিতেন।

তার প্রমাণ পাই- নিহত হওয়ার পরে যখন এই খবর ছড়িযে পড়ল, তখন হাজার হাজার লোক মরহুম হকের লাশ দেখতে আসে। গ্রামের সমস্ত মানুষ খুনীকে খুঁজতে আরম্ভ করে দেয়। সমস্ত থানা-এলাকা খুঁজে একটা ঘরের মাচায় তারা দুইজন পলাতকের সন্ধান পায়। তাদেরকে সন্ধান করে সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণ হত্যাকারী সন্দেহে খুঁজে বাহির করে নেয়। ক্রুদ্ধ জনসাধারণ তাদেরকে মারধর করেও বলে জানা যায়। পুলিশ অনেক চেষ্টা করে যখন তাদের উদ্ধার করে, তখন তারা অর্ধমৃত অবস্থায় ছিল । তারা মারা যাওয়ার আগে স্বীকার করে যে, তারা হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল। তাদের কাছে অস্ত্র পাওয়া যায়।

পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও তাদের মৃত্যু থেকে রক্ষা করতে পারেনি। সরকারের পক্ষে এতে কিছুটা ক্ষতি হয়েছে । আমরা খোঁজ করতে চেয়েছিলাম, এর পেছনে কী ষড়যন্ত্র আছে। বিদেশীদের পয়সা খেয়ে কিছু লোক এসব হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু তারা জানে না, কোন দেশে কোন যুগে রাতের অন্ধকারে দুই- একজনকে হত্যা করে কোন সরকারের পতন ঘটানো যায় না, দেশের মধ্যে . বিপ্লব আনা যায় না। চোর-ডাকাতরাই এই ধরণের কাজ করে। আমাদের দেশে কিছু লোক আছে, যারা মনে করে যে, একজন- দুইজনকে হত্যা করে দেশের স্বাধীনতা নষ্ট করা যাবে, দেশের মধ্যে বিপ্লব সৃষ্টি করা যাবে।

কিন্তু তারা মৃখ্যের স্বর্গে বাস করেছে। আমরা আমাদের নীতির জন্য বহু লোককে হারিয়েছি। লক্ষ লক্ষ লোক স্বাধীনতা-সংগ্রামে জীবন দিয়েছে। অনেকে অনেকভাবে আমাদের বিরুদ্ধাচারণ করেছেন – অনেকদিন পর্যন্ত । কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা সংখাম করে স্বাধীনতা এনেছে। তাই আমরা যারা এই সংসদে সদস্য হিসেবে যোগদান করেছি, যারা মাতৃভূমিকে ভালবাসি, বাংলাদেশকে ভালোবাসি, বিশ্বাস করি যে দেশের স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য সংসদের সদস্য আমরা যারা এখানে আছি, তারা সবাই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত আছি।

কিন্তু স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করতে প্রস্তত নই। আমি জানি, নূরুল হকের মৃত্যুর খবর শুনে হাজার হাজার লোক ছুটে এসেছে। নুরুল হক আমাদের একজন সত্যিকার বন্ধু-লোক ছিলেন, একজন নিশ্বার্থ কর্মী ছিলেন, তার কাছ থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিৎ। আমি বলতে চাই যে, এ দেশে সরকার আছে, এ দেশে জনসাধারণ আছে। বাংলাদেশ বিরাট জায়গায় নয়- অপরাধীকে আমরা খুঁজে বের করতে পারব। বিদেশের পয়সায় যারা এসব অন্যায় কাজ করে বেড়াচ্ছে, তাদের আমরা উপযুক্ত শান্তি দিতে পারব। এই হত্যা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করতে হবে

 

২ জুন ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
২ জুন ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

 

। আমরা যারা এখানে উপস্থিত আছি, যারা আমার সহকর্মী আছে এবং আপনিও আমার বাইশ বছরের সহকর্মী জনাব স্পীকার। আপনারা সবাই জানেন, আমি অন্যায়ের কাছে কোনদিনই মাথা নত করতে শিখিনি। জেল, জুলুম, বা ফীসীকে কোনদিনই ডরাইনি। মেশিনগানের সামনে বুক পেতে দেওয়ার ক্ষমতা রাখি ।” তাই বাংলার স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য, বাং র জনসাধারণকে যদি আবার ডাক দেওয়ার দরকার হয়, তাহলে আমি সে ডাক অবশ্যই দেব। এতে আমার কোন সন্দেহ নাই যে, বাংলার মানুষ আমার ডাকে আবার ঝাঁপিয়ে পড়বে। বাংলার মাটি থেকে এসব দুক্কৃতিকারীকে সমূলে উৎখাত করতে হবে ।

হও। বঙ্গবন্ধু কঠোর হতে জানে। তারাই দেশের মধ্যে বিদেশের পয়সায় বিশৃংখলার সৃষ্টির চেষ্টা করছে, যারা আমাদের স্বাধীনতার জন্য সাহাব্য করেনি এবং আজ স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার জন্য ষড়যন্ত্র করছে। যারা সম্মুখ-সমরে মোকাবেলা করতে পারে না, তারাই রাত্রির অন্ধকারে চোর- ডাকাতদের ন্যায় অন্যকে গুলি করে হত্যা করে। নুরুল হক যখন ঘরে বসে কথা বলছিলেন, তখন জানালা দিয়ে গুলি করে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। এটা কাপুরুষের কাজ । আমি বিশ্বাস করি, কোন মানুষ এটা করতে পারে না। যারা রাজনীতি করে, তারা এটা করতে পারে না। কোন শিক্ষিত লোক এটা করতে পারে না।

যাঁরা দেশকে ভালবাসেন, তারাও এটা করতে পারেন না। এই হত্যাকাণ্ড যে অত্যন্ত দুঃখজনক, তা অবশ্যই বলতে হবে। ৃ আমরা যাতে এ সমস্ত দুষ্কৃতিকারীকে বাংলাদেশ থেকে উৎখাত করতে পারি, তার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই গ্রহণ করব। জনাব স্পীকার সাহেব, জনগণের সাহায্য নিয়ে নিশ্চই তাদের উৎখাত করার চেষ্টা করা হবে। আজকে তাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। এই রাস্তা বড়ই খারাপ রাস্তা। এই রাস্তা অনুসরণ করা কারও পক্ষে উচিৎ নয়। আমার. নাই। আমি এ গ্রামের লোককে চিনি এবং তারাও আমাকে চেনে। আমি ওদের বাড়িতে গিয়েছি।

কী দিয়ে আমি তাদের সান্তনা দেব? আমি এ কথাই এখানে বলতে চাই যে, তার রক্ত যেন বৃথা না যায়- এই শিক্ষা আমাদের গ্রহণ করা উচিৎ । আমি আবার বলব, এটাই আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যে, এই নিঃস্বার্থ আত্মবিসর্জন যেন বৃথা না যায়। এই বলে আপনি সংসদের সামনে যে শোক প্রস্তাব এনেছেন, তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি। খোদা হাফেজ! জনাব স্পীকার ৪ এক্ষণে আমি মাননীয় সদস্যগণকে অনুরোধ করব, তারা যেন নীরবে দুই মিনিট দাঁড়িয়ে মরহুম জনাব এ এফ এম নূরুর হক মোনাজাত করেন।

 

( সদস্যগণ কর্তৃক দাঁড়িয়ে দুই মিনিট নীরবতা-পালন ও প্রার্থনা )

Bangabandhu Gurukul

 

আরও পরুন :

Leave a Comment