৩১শে জানুয়ারী ১৯৭৪ যুগোস্লাভিয়া প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটুর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর ভাষণঃ আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় প্রেসিডেন্ট টিটু ও মাদাম টিটু । মহামান্য নেত্রীবৃন্দ, ভদ্দ মহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ। আমাদের দেশে আপনার শুভাগমন উপলক্ষে আপনাকে, মাদাম লর্ড, আপনার দলের অন্যান্য সদস্যদের আস্ত রিক অভ্যর্থনা জানাতে পেরে আমি, আমার সরকার এবং বাংলাদেশের জনগণ অত্যন্ত আনন্দিত । আমাদের দেশের জনগণের অন্তরে আপনার জন্য একটা বিশেষ প্রশংসার আসন রয়েছে।
৩১শে জানুয়ারী ১৯৭৪ যুগোস্লাভিয়া প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটুর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
চিরদিন আপনি সেখানে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী হয়ে থাকবেন। আমাদের জনগণ ১৯৬৮ সালে আপনাকে আরো একবার স্বাগত জানাবার সুযোগ পেয়েছিল । তবে আপনার বর্তমান সফর বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে এই আপনার প্রথম শুভাগমন। আপনার সামনে এটা উল্লেখ করা বস্তত নিস্প্রয়োজন যে, দেশ ভাগ্যের একটা কঠিন শোষণের পর একটা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন হয়েছি।
প্রথম শুভাগমন চলাকালে এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে আপনি ও আপনার সরকার যে বৈদেশিক সাহায্য ও নৈতিক সমর্থন দিয়েছে তা গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে এ উপলক্ষ্যে আমি স্মরণ করছি। তাছাড়া পাকিস্তানে অন্তরীণ অবস্থায় আমি যখন ফাঁশি কাষ্ট্রের মুখোমুখী হয়েছিলাম, তখন জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমি কৃতজ্ঞ। মি. প্রেসিডেন্ট, গত বছর আমি যখন, আমরা আপনার সুন্দর দেশ সফরে যাই_ তখন আপনি, আপনার প্রধানমন্তরী…… এবং যুগোস্লাভিয়া জনগণ আমাকে ও আমার দলের অন্যান্য সহ্যাত্রীদের যে প্রাণঢালা আতীথেয়তা এবং উদাসহীন আপ্যায়ন করেছিলেন, তা আমি ভুলতে পারি নাই।
আমাদের দু’দেশের মধ্যে যে সহজাত স্বতস্কূর্ত বন্ধুত্ব এবং সহযোগীতার জন্ম হয়েছে- তার মূল উৎস হচ্ছে আদর্শের অভিন্নতা এবং একই ধরণের অভিজ্ঞতা । এছাড়া বিভিন্ন গুরুত্পূর্ণ সমস্যার নিস্পত্তির ব্যাপারেও আমাদের দৃষ্টি ভঙ্গির বৈষম্যহীন রয়েছে। সমাজতন্ত্রের উত্তরণের পথে আপনার দেশকে প্রসংশনীয় সাফল্যে পরিচালিত করে আপনি আপনার দেশের জনসাধারণকে পৌঁছে দিয়েছেন প্রগতি ও সমৃদ্ধির সোপানে। মি. প্রেসিডেন্ট, আমরা আমাদের রাষ্ট্রীয় মূল নীতির প্রধান লক্ষ্য হিসাবে সমাজতন্ত্রকে বেছে নিয়েছি।
আমাদের নিজন্ব পরিবেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জন করতে আমরা বদ্ধ পরিকর । আমাদের যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে পুণগঠিনের জন্য এখন আমাদেরকে শক্তিশালী চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আমাদের বিগত উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে দেশব্যাপী চার হাজারেরও অধিক স্থানীয় সংস্থার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন। এছাড়া আমরা আমাদের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কাজও শুরু করেছি। যার লক্ষ্য হচ্ছে আমাদের জনগণকে অর্থনৈতিক মুক্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ।
মি. প্রেসিডেন্ট, আপনি নিশ্চই সহনশীল একজন ক্লান্ত সেনানী। জোট নিরপেক্ষতার একজন উৎসাহী হিসাবে শান্তির জন্য আপনার নিরলস পরিশ্রম, দূরদশীতা আজ সর্বজন স্বীকৃত। ১৯৬১ সালের বেলুচের সংগ্রামের দিনগুলি থেকে আজ পর্যন্ত যে দূরদশীতা বুদ্ধিমত্তা ও সংঘাতহীন জোট নিরপেক্ষতার ধ্যান-ধারণাকে শৈশব অবস্থা থেকে বলিষ্ঠ গতিশীল সূচিতে রূপান্তরিত করেছেন, তা আজ ব্যাপকভাবে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এবং তাৎপর্যপূর্ণ অবদান বুঝাচ্ছে, অতএব মি. প্রেসিডেন্ট, আন্তর্জাতিক সমাজের জন্য আপনাকে যে জহরলাল নেহেরু বলে অবিহিত করেছে_ তা যথার্থই সঠিক হয়েছে।
শান্তি ও জোট নিরপেক্ষতার নীতির প্রতি আপনার যে আনুগত্য- তাতে আমরা বাংলাদেশের জনগণ সমভাবে অংশীদার। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, গণতান্ত্রিকরণ, শান্তিপূর্ণ সহবস্থান, কোন রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে হস্ত ক্ষেপ থেকে বিরত থাকা এবং অন্যের সার্বভৌমত্রে প্রতি সম্মান প্রদর্শন সম্পর্কেও আমরা আপনার সঙ্গে সমভাবে আস্থাশীল।
বন্ততঃ মি. প্রেসিডেন্ট, আমাদের বৈদেশিক নীতির মুলভিত্তি হচ্ছে জোট নিরপেক্ষতা । শুধু তাই নয়, জোট নিরপেক্ষতা আমাদের সর্থবধানের অন্যতম অনুশাসন। তাই আপনার সহযোগীতায় আইডিয়াতে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে পরিপূর্ণ ও সক্রিয়ভাবে শরীক হতে পেরে আমরা সত্যই গভীরভাবে খুশি হয়েছি। তাই বৃহৎ সম্মেলনের যত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক – ্রস্তাবলী কার্যকরি করতে আপনারা একান্তই চেষ্টা করবেন- এ বিশ্বাস আমাদের আছে। শান্তির প্রতি আমাদের অনুগত্য থাকবেই।
কারণ শান্তির পরশেই আমরা আমাদের স্বাধীনতার বুনিয়াতকে মজবুত করতে পারি। শান্তি অক্ষুন্ন থাকলেই দারিদ্র, ক্ষুধা, বেদী ও দেশরক্ষার সংঘ্ামে আমাদের সম্পদ সমর্থকে কাজে লাগাতে পারি। তাই উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকরণের লক্ষ্যে আমরা জোট নিরপেক্ষ গঠনমূলক প্রবৃদ্ধির নীতি অনুস্মরণ করছি। আমাদের বিশ্বাস- কাজে ও কথায় দিল্লি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তির পথকে সুগম করবে ।
বিশ্বব্যাপি উপনিবেশবাদ, সমত্রাজ্যবাদ ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত সংঘামে আপনার যে সমর্থন_তাতে আমরা আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একাতৃ। এছাড়া অস্ত্র প্রতিযোগিতার অবসান করে দুস্থ মানবতার কল্যানে মূল্যবান সম্পদকে নিয়োগ করার জন্য আপনার যে মহান, আপনার যে আহ্বান_ তাতে আমরা আপনার সঙ্গে একমত । পশ্চিমে… এখনও শান্তি ফিরে আসেনি । একটি…. হওয়া সত্তেও আমাদের মতে এই ভূ-খন্ডে কোন স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে না। যতদিন না ইসরাইল কর্তৃক বে-আইনিভাবে দখলকৃত ভূমি আরবরা ফিরে পাবে এবং ফিলিস্তিন বাসীদের ন্যায় সঙ্গত অধিকার পূর্ণ প্রতিষ্ঠা হবে।
তাই গভীর সংকটের বিষয় যে, আজ এমন একজন বন্ধুর সামনে আরব-ফিলিস্তিনের ভাইদের ন্যায়-সংঘত সংগ্রামের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থনের ঘোষণা করতে পেরেছি, যিনি সর্বদাই আরব….সর্বকালের যুক্তি সংগ্রামের প্রতি মূল্যবান সমর্থন দিয়ে এসেছেন। আমাদের স্বাধীনতার পর থেকে ও অতি স্বল্পকালের মধ্যে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের এই দুই দেশের মধ্যকার বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার ঘনিষ্ঠ বন্ধন আগামী দিনগুলিতে আরো শক্তিশালী হবে ।
মহামান্য অতিথীবৃন্দ, ভদ্রমহিলা ও জদ্রমহোদয়গণ এবার আমি আপনাদেরকে, আমাদের মহামান্য অতিথী প্রেসিডেন্ট জোসেফ ব্রস্ট টিটু ও মাদাম ব্রগের সুস্বাস্থ, ও দীর্ঘায়ু এবং যুগশ্নীভিয়ার বন্ধু জনগণের জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধি এবং যুগশ্লাভিয়া ও বাংলাদেশের দীর্ঘাস্থায়ী বন্ধুত্ব কামনা করে চা চক্রে যোগদান করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি । জয় যুগশ্মাভিয়া, জয বাংলা ।
আরও পরুন :
- ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালের জাতীয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণ
- ২৫ অক্টোবর ১৯৭৩ সালের জাপান থেকে ভ্রমণ শেষে তেজগাঁও বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের সামনে ভাষণ
- ১৭ অক্টোবর ১৯৭৩ সালের ধ্যপ্রাচ্যে গমন উপলক্ষে বাংলাদেশ মেডিকেল দলের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত ভাষণ
- ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সালের ভৈরবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
- ১৯ আগষ্ট ১৯৭৩ সালের বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী; সময়রেখা [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman ]