বঙ্গবন্ধুর সরকার – ৭৪ এর খাদ্যাভাব : স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু সরকারের শাসনামলে ১৯৭৪ সালের খাদ্যাভাব ছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। যে ঘটনাটিকে বঙ্গবন্ধুর বিরোধীরা বিশেষভাবে প্রচার করে তাঁর সমস্ত অর্জন ব্যর্থতায় পর্যবসিত করার চেষ্টা করে । দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণহানির তথ্য প্রচার করে। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৪ সালে খাদ্যাভাবের পিছনে কী কারণ, তা যদি সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা যায় তা হলে যেটি পাওয়া যায় তা হলো- ১৯৭৪ সালের জুন, জুলাই এবং আগস্ট মাসে পর পর তিন বার বন্যা আঘাত হানে।

কোনো কোনো এলাকায় আউশ ফসল পুরোপুরি ধ্বংস হয় এবং আমন চারা রোপণের পর নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি সেপ্টেম্বর মাসেও বন্যা শেষ বারের মতো আঘাত হানে। ফলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরপর তিনবার বন্যায় ফসলের ক্ষতি হলেও বঙ্গবন্ধু সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে ১৯৭৪-৭৫ অর্থ-বছরে ধানের উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ১১ লক্ষ ৯ হাজার মেট্রিক টন যা ১৯৭৩-৭৪ সালের তুলনায় মাত্র ৫.২২% কম।
কিন্তু বন্যায় শ্রমিক শ্রেণি তথা দৈনিক ভিত্তিতে আয় অর্জনকারী পেশাদারগণের (কামার, কুমার, জেলে, ধোপা, নাপিত) আয় অনেকাংশে কমে যায়। এছাড়াও ধান উৎপাদন খুব একটা কম না হলেও স্বাভাবিক ঘাটতি দূর করার জন্য যে পরিমাণ আমদানির প্রয়োজন ছিল আমদানি করতেও সরকারকে বেশ প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। প্রতিকূল পরিস্থিতিগুলো হলো :
প্রথমত, U.S.A-এর কালো তালিকাভুক্ত কিউবার সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। কিউবায় বাংলাদেশের পাটের বাজার ছিল খুবই প্রশস্ত। কিন্তু আমেরিকা বাংলাদেশকে কিউবার সাথে বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করার জন্য চাপ দেয় এবং খাদ্য আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ বাধ্য হয়ে খাদ্য বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করে ।
দ্বিতীয়ত, ১৯৭৪ সালে ওপেকের তেলের মূল্য প্রতি ব্যারেল আড়াই ডলার থেকে ১০ ডলারে পৌঁছে। তেলের এই দাম বৃদ্ধির ফলে বিশ্ব বাজারে প্রতিটি জিনিসের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যায়। যেমন – ১৯৭১ সালে প্রতি টন চালের দাম ছিল ৭০ ডলার। ৭৪ সালে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩৭০ ডলার। খাদ্যসহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। সেই সময়ে বিশ্বজুড়ে খাদ্যঘাটতি দেখা দিলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র টাইটেল দুই-এর অধীনে বাংলাদেশে তাদের দেয়া খাদ্য রপ্তানির পরিমাণ বিপুলভাবে কমিয়ে দেয়।

তৎকালীন সময়ে হেনরি কিসিঞ্জারের সফরের পর বিদেশি রপ্তানিকারকরা “Third party guarantee” ছাড়া বাংলাদেশে রপ্তানি করতে নারাজ, কারণ তাঁরা সন্দেহ করছে বাংলাদেশ সরকার তাদের পণ্যের দাম দিতে পারবে কি না। এমন পরিস্থিতিতেও বঙ্গবন্ধু সরকার খাদ্যঘাটতি মেটানোর লক্ষ্যে ১৯৭৪-৭৫ সালে ১৯,৮৬০ মেট্রিক টন চাল ও ১৫,৬০,১০০ মেট্রিক টন গম মোট ১৫,৭৯,৯৬০ মেট্রিক টন খাদ্য আমদানি করে, যা ১৯৭৩-৭৪ সালের আমদানিকৃত খাদ্যের ৯৫%।
এ প্রসঙ্গে আরও একটি তথ্য বিশেষভাবে উল্লেখ্য, তা হলো, ১৯৭৪-৭৫ সালে দেশে দৈনিক মাথাপিছু গড় খাদ্য প্রাপ্তির পরিমাণ ছিল ১৪.৮ আউন্স যা একজন মানুষের জন্য অনেকটাই স্বাভাবিক ১৯৬৯-৭০ সালে যেটি ছিল ১৭.১ আউন্স, ১৯৭৯-৮০ সালে ১৫.৩ আউন্স এবং ১৯৮৫-৮৬ সালে ১৫ আউন্স । সুতরাং অন্যান্য বছরের তুলনায় ১৯৭৪-৭৫ সালে খাদ্য প্রাপ্তির পরিমাণ মোটেও অসন্তোষজনক ছিল না। খাদ্যাভাব দেখা দেওয়ার যে মূল কারণ ছিল তা হলো ক্রয়-ক্ষমতার অভাব।
এই খাদ্যাভাব মোকাবেলা করার জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার সারা দেশব্যাপী পর্যাপ্ত লঙ্গরখানা খুলেছিলেন যেখান থেকে মোট জনসংখ্যার ৬% খাবার পেয়েছে। জেলা ওয়ারি লঙ্গরখানা থেকে খাবার গ্রহণের তথ্যে দেখা যায় রংপুরে ১৭.১৮%, ময়মনসিংহে ১১.৮৮%, দিনাজপুরে ৮.৬% এবং সিলেটের ৭.৬২% লোক লঙ্গরখানার খাবার খেত। ৪৩ লক্ষ লোককে রিলিফ দেওয়া হয়েছিল।
জেলাওয়ারি লঙ্গরখানা থেকে খাদ্য গ্রহণের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় রংপুরে সবচেয়ে বেশি খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছিল। যে রংপুরে স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরেও বিশেষ সময়ে মানুষের হাতে কাজ না থাকার কারণে মঙ্গা দেখা দেয়।
৭৪ এর খাদ্যাভাব এর কারণ
সার্বিকভাবে ১৯৭৪ সালে দেশে যে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছিল তার পিছনে যে কারণগুলি ছিল তা হলো :
১. পরপর তিনবার বন্যায় ফসলের ক্ষতি।
২. বন্যার কারণে দরিদ্র মানুষের কাজের সুযোগ কমায় আয় কমে যাওয়া এবং ক্রয়-ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া ।
৩. ওপেকে তেলের মূল্য বৃদ্ধিজনিত কারণে খাদ্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি
৪. বিশ্বজুড়ে খাদ্যঘাটতি।
এতসব প্রতিকূল অবস্থার মাঝেও দেশের নিজস্ব উৎপাদন এবং আমদানিসহ খাদ্য সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল। দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কম থাকার কারণে লঙ্গরখানা খুলে এবং রিলিফের মাধ্যমে খাদ্য বণ্টন সুষ্ঠু করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তারপরও প্রায় ২৭ হাজার লোক অনাহারে মৃত্যুবরণ করেছে।
বঙ্গবন্ধু ৭৪ এর খাদ্যাভাব সম্পর্কে জাতীয় সংসদে ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন, “সমস্ত দুনিয়ায় যে ইনফ্লেশন হয়ে গেল, শুধু আমরা না সমস্ত দুনিয়ার যারা অনুন্নত দেশ তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে এক ভয়াবহ বন্যা । যে বন্যা – এতবড় বন্যা আমার জীবনে আমি দেখেছি কিনা সন্দেহ। না ছিল খাবার। পাঁচ হাজার সাত শত লঙ্গরখানা খোলা হলো এবং সেখানে রিলিফ অপারেশন চালান হলো।
বন্ধুদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে নিজেদের কাছে যা কিছু ছিল তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। বাঁচাতে পারলাম না সকলকে। ২৭ হাজার লোক না খেয়ে মারা গেল। এখনো মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। গায়ে তাদের কাপড় নাই ।” ১৯৭৪ সালে দেশে যে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছিল তাকে মোটেই দুর্ভিক্ষ বলা যায় না কারণ দুর্ভিক্ষের অর্থ হচ্ছে খাদ্য সংকট। কিন্তু ১৯৭৪ সালে খাদ্যের কোন সংকট ছিল না।
যেটির সংকট ছিল তা হলো দরিদ্র মানুষের খাদ্য ক্রয় করার মতো অর্থের সংকট। এই ক্রয়ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার জন্য মানুষের মৃত্যু অহরহই ঘটে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ খাদ্যের ন্যায় আরও একটি মৌলিক অধিকার হচ্ছে চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার। দেশে অনেক রোগের চিকিৎসা ছিল বা আছে যা দরিদ্র মানুষ অর্থের অভাবে সেই চিকিৎসা নিতে পারছে না ফলে মৃত্যুবরণ করছে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ সালে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে দেখা যায় ধনী মানুষের মধ্যে প্রসূতি মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৭২ জন, পক্ষান্তরে দরিদ্র মানুষের মধ্যে প্রসূতি মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১৪০ জন। সুতরাং দেশে পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও দরিদ্র মানুষের সেই চিকিৎসা সেবা ক্রয়ের মতো অর্থ না থাকার কারণে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। কিন্তু এই মৃত্যুর জন্য কোনো সরকারকে দায়ী করা হয়েছে বলে মনে হয় না।
সুতরাং বঙ্গবন্ধু বিরোধীরা ১৯৭৪ সালের খাদ্যাভাবের জন্য যেভাবে তাঁর সরকারকে দোষারোপ করেছে বা এখনও সেই কল্পকাহিনি প্রচার করে যাচ্ছে তা সম্পূর্ণই মিথ্যা এবং অপপ্রচার। তবে ১৯৭৪ সালে খাদ্যাভাবের কারণ, উক্ত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ, উক্ত পরিস্থিতির ওপর জাতীয় সংসদে প্রদত্ত ভাষণ এবং বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি (বিশেষ করে চিকিৎসা সম্পর্কিত যে উদাহরণটি দেওয়া হলো) বিশ্লেষণ করে অনুধাবন করা যায় যে, বঙ্গবন্ধু দেশের দরিদ্র মানুষকে কতটা হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন।
আরও পড়ুন:
“বঙ্গবন্ধুর সরকার – ৭৪ এর খাদ্যাভাব”-এ 1-টি মন্তব্য