৭ এপ্রিল ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণঃ শনিবার, সকার ১০ টায় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (প্রধানমন্ত্রী, পরিষদ নেতা) : জনাব স্পীকার সাহেব, আপনাকে এবং জনাব বায়তুল্লাহ সাহেবের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার নির্বাচিত করা হয়েছে। আমি আপনাকে এবং ডেপুটি স্পীকার সাহেবকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই । আপনারা দু’জনই দেশের জন্য যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আপনাদের ত্যাগের কথা জনসাধারণ জানে ।
৭ এপ্রিল ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ | বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন
আমি নতুন করে সে কথা আলোচনা করতে চাই না। যখন শাসনতন্ত্র তৈরি করা হয়, তখন আপনি স্পীকার ছিলেন এবং জনাব বায়তুল্লাহ সাহেব ডেপুটি স্পীকার ছিলেন। আপনারা সুষ্ঠভাবে গণপরিষদের কার্য পরিচালনা করেছেন। আমরা দেশের কাছে একটা সর্ববিধান দিতে পেরেছি। সেজন্য আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ না জানিয়ে পারছি না। আপনার কর্তব্য পালনে, সংসদের সদস্যবৃন্দ সব সময় আপনার সঙ্গে সহযোগিতা করবেন । আমি আশা করব যে, ট্রাডিশন পার্লামেন্টারী সিস্টেমে আছে, আপনি সেটার প্রতি লক্ষ্য রেখে নিরপেক্ষভাবে আপনার কার্য পরিচালনা করবেন।
আমাদের কাছ থেকে আপনি সাহায্য ও সহযোগিতা পাবেন। এই সংসদের মর্ধাদা যাতে রক্ষা পায়, সেদিকে আপনি খেয়াল রাখবেন, কারণ আমরা যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছি, সে ইতিহাসে যেন খুঁত না থাকে। দুনিয়ার পার্লামেন্টারী কনভেনশনে যেসব নীতিমালা আছে, সেগুলো আমরা মেনে চলতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে যেন এমন একটি perliamentary procedure follow করতে পারি, যাতে দুনিয়া আমাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
আমি আপনার বেশী সময় নষ্ট করতে চাই না। আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়ে বলতে চাই যে, আপনাকে একদল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। দুঃখের বিষয়, অন্যকোন দল গ্যাসেম্বলীতে আসতে পারেনি। সেজন্য আমি দুঃবিত। কিন্তু জোর করে জনসাধারণকে বলতে পারি না . ভাট দাও’। অন্য কোন দল ভোট না পেলে আমার কিছু বলার নেই। আপনি প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত স্পীকার । এখানে কোন দল বা মতের নয়-এখানে এই দেখব যে, প্রত্যেক সদস্য যেন যার যে অধিকার আছে, সে অধিকার ব্যবহার করতে পারেন। সেদিকে আপনিও খেয়াল রাখবেন বলে আমি আশা পোষণ করি। এ সম্পর্কে আপনি আমাদের পূর্ণ সহযোগিতা পাবেন। Parliamentery tradition পুরোপুরিভাবে follow করতে আমরা চেষ্টা করব।
আমি আপনার সহকর্মী ডেপুটি স্পীকার জনাব বায়তুল্লাহ সাহেবকেও অভিনন্দন জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি। ধন্যবাদ । শোক প্রস্তাবের উপর আলোচনা জনাব স্পীকার,এই সংসদ গভীর শোক ও সমবেদনার সহিত প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলাদেশের প্রাক্তন গণপরিষদ সদস্য জনাব আবদুর রব (বেগা মিয়া) সাহেবের আকস্মিক ও মর্মান্তিক মৃত্যুতে বাংলাদেশ ইহার একজন দেশপ্রেমিক, একনিষ্ঠ সমাজকর্মী, জনদরদী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী কৃতি সন্তানকে হারাইয়াছে। এই সংসদ মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করিতেছে এবং তীহার শোক সন্তপ্ত পরিবারের নিকট গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করিতেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (প্রধানমন্ত্রী, পরিষদ নেতা) $ জনাব স্পীকার সাহেব, বড়ই দুখের সঙ্গে আজ শোক প্রস্তাব শ্রবণ করছি।
সে সম্বন্ধে কিছ বলতে গিয়ে খুব কষ্ট হয়। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে মরহুম আবদুর রব (বগা মিয়া) যে সংঘাম এবং কষ্ট স্বীকার করেছেন, তার নজির মেলে না। তিনি যে নির্বার্থভাবে দেশের জন্য কাজ করেছেন, সে কথা বলতে গিয়ে অনেক কথাই আমার মনে পড়ে। বড়ই দুখের সঙ্গে আমাকে বলতে হয়, তদানীত্তন পাকিস্তানে যখন বিরোধী দল সৃষ্টি করি, তখন বগা মিয়া এগিয়ে এসেছিলেন।
প্রত্যেকটি ১৪ গণ-আন্দোলনের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন এবং বরাবরই দুখ-কষ্ট সহ্য করেছেন। গত স্বাধীনতা-সংগ্রামের সময় তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে যান। তথাপি তিনি সক্রিয়ভাবে অশংগ্রহণ করেন। কিন্তু এক আকম্মিক মোটর দুর্ঘটনায় মারা যান। দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়ে আমি নাটোর থেকে পাবনা গিয়েছিলাম । আমি দেখলাম, তীর লাশ দেখে মনে হল, তিনি হাসছেন।
তাকে ভাল না বাসে এমন কোন লোক নাই। দলমত নির্বিশেষে প্রত্যেকে তাকে ভালবাসত। পাবনা জেলার প্রত্যেকটি লোক তাকে ভালবাসত। তীর নিজের ছেলেমেয়ের খাওয়া হয়েছে কিনা, তিনি কোন সময় তা দেখতেন না। যা কিছু উপার্জন করতেন, দুই হাতে বিলিয়ে দিতেন। এই রকম নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমের নজির আমরা দেখি না। তীর এই মর্মান্তিক মৃত্যুতে- আমার কাছে এমন কিছু নাই যে, তার ছেলেমেয়েকে সান্তনা দেব। আমি বক্তব্য পেশ করার সময় বারবার শুধু “বগা মিয়া’ বলেছি, কারণ দেশের লোক তকে “বগা মিয়া” বলেই জানত।
আমি শুধু বলতে পারি যে, মানুষকে জীবনে বহু দুঃখ-কষ্ট বরণ করে নিতে হয় এবং অনেক কিছুই সহ্য করে নিতে হয়। খোদার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করার নাই আমার। সেজন্য আমি আমার সহকর্মী নির্বাচিত সদস্যদের বলব, এই সংসদে যখন শাসনতন্ত্র তৈরি করা হয়, তখন তিনি সদস্য ছিলেন এবং যে শাসনতন্ত্র এ দেশ পেয়েছে। সে শাসনতন্ত্র- যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন চলবে এ দেশে। তাই আজ আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে স্মরণ করছি বগা মিয়ার কথা। আমি তার শোকসন্তপ্ত আত্রীয়-স্বজনের নিকট সকলের পক্ষ থেকে সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।
তীর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। তারপর আমি স্মরণ করছি মরহুম সওগাতুল আলম সগীরের কথা। তাকে আমি ছোটকাল থেকেই জানতাম। ছাত্র জীবন থেকে তিনি ছাত্র লীগের একনিষ্ঠ কর্মী হিসাবে রাজনীতি শুরু করেন। তারপর সক্রিয়ভাবে আওয়ামীলীগের কর্মী ছিলেন। ১৯৬৬ সালে বাংলাদেশের যে ৬-দফা আন্দোলন হয়েছিল, সওগাতুল আলম ছিলেন তার অন্যতম কর্মী। হত্যা করা হয়েছে। তিনি রাত্রিতে যখন মিটিং করে বাড়িতে ফিরছিলেন, তখন পিছন থেকে গুলি করে তীকে হত্যা করা হয়েছে।
এছাড়াও আওয়ামীলীগের বহু কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। আজ পর্যন্ত ১৩২ জন আওয়ামীলীগ কর্মীকে রাতের অন্ধকারে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। দুস্কৃতিকারীরা এদের হত্যা করেছে। মরহুম সওগাতুল আলম যেভাবে দেশের মানুষের সঙ্গে কাজ করেছেন, গ্রামে গ্রামে পায়ে হেটে কাজ করেছেন, তা খুবই প্রশংসনীয় । তিনি কতবার যে আমার কাছে এসেছিলেন এবং দুইবার তাঁর এলাকাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। যতবারই তিনি আমার কাছে এসেছিলেন, তারমধ্যে তার নিজের জন্য একবারও এসেছিলেন কিনা আমার জানা নেই ।
আজ আমার চাই, সাহায্য চাই, ইত্যাদি ছিল আমার কাছে তার চাওয়া । দেশের মানুষকে তিনি যে ভালবাসতেন, এ সম্বন্ধে কোন সন্দেহ ছিল না। কিন্ত দুম্কৃতিকারীর নির্মম হাতিয়ার তার জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছে। আমি আশা করি এই শোক প্রস্তাব পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার মাটি থেকে যেন এই গোপন হত্যা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ গোপন হত্যায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন কোনদিন হতে পারে না। দুনিয়ার ইতিহাসে এ রকম কোন নজির নাই।
গোপন হত্যা করে কোনদিন দেশের মঙ্গল করা যায় না। দেশের মধ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে গেলে নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনবেন। দুক্কৃতিকারী যারা আছে, তারা যেন নিশ্চিতভাবে এ কথা জেনে রাখে। জনাব স্পীকার সাহেব, বাংলার মাটিতে অন্যায়ভাবে যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে, জনগণের সহযোগিতায় বর্তমান সরকার তাদের শায়েস্তা করবেই। দরকার হলে এমন আঘাত করবে, যাতে এরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই নেতা ও কর্মীকে পাকিস্তানের বর্বর বাহিনীর সৈন্যরা হত্যা করেছে, যেমন সেটাতে তেমন দুঃখ হয় না;
কিন্তু জনাব স্পীকার সাহেব, গুপ্তভাবে রাতের অন্ধকারে দেশের যেসব নিঃস্বার্থ কর্মীকে জীবন দিতে হচ্ছে, তার চেয়ে দুঃখের ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না। মশিউর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তীকে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাক সামরিক বাহিনী প্রথমে প্রহার করে, তারপর তাদের গাড়ির পিছনে বেঁধে ৫০ মাইল পর্যন্ত গাড়ি চালিয়ে হত্যা করেছে। তার সমস্ত শরীরের মাংস খুলে গিয়েছিল। এছাড়া আওয়ামীলীগের আরও. অনেক কর্মী ১৬ তাদের যন্ত্রণার শিকার হয়েছিল। চট্টগ্রামে আমার সহকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে।
সেজন্য আমি এ শোক প্রস্তাবের পরে বলতে চাই যে, যারা সংশ্বাম করেছিলেন, স্বাধীনতা-যুদ্ধ করেছেন, দেশের মঙ্গলের জন্য জীবন দিয়েছেন, যারা শহীদ হয়েছেন এবং এ ধরণের জীবন মানুষ যুগ যুগ ধরে দিচ্ছে, এতে সন্দেহ নাই। কিন্তু দুখের বিষয়- এখন যে রাতের অন্ধকারে যেভাবে আওয়ামীলীগ কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে এবং হচ্ছে এটা কোন রাজনৈতিক দলের কমীহি সমর্থন করেন না। সেজন্য জনাব স্পীকার সাহেব, আমি তাদের শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমার অন্তর থেকে সমবেদনা প্রকাশ করছি।
আমার বক্তব্য শেষ করব। শুধু এইটুকু বলব, তাদের আত্মা যেন শান্তি পায়। আমি তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। জনাব স্পীকার ৪ এক্ষণে আমি মাননীয় সদস্যগণকে অনুরোধ করব, তারা যেন নীরবে দুই মিনিট দীড়িয়ে মরহুম জনাব সওগাতুল আলম ও জনাব আবদুর রবের আত্মার শান্তির জন্য পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার নিকট মোনাজাত করেন।
আরও পরুন
- বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ রচনা ১০০০ + শব্দ | বাংলা প্রবন্ধ রচনা
- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংক্ষিপ্ত জীবনী [ ছবির গ্যালারি সহ ]
- বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় শিক্ষার গুরুত্ব – পাশা মোস্তফা কামাল
- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ ও প্রেক্ষাপট লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক
- আমাদের শেখ রাসেল রচনা । ১০০০ শব্দ । প্রতিবেদন রচনা