বঙ্গবন্ধুই প্রথম দুর্যোগের পূর্বপ্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থার গুরুত্ব অনুভব করেন – মোঃ সেলিম হোসেন
ভৌগলিক অবস্থান ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে জনবহুল বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দুর্যোগ প্রবণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদী ভাঙ্গন, ধরা, শৈত্য প্রবাহ, অগ্নিকাণ্ড, বজ্রপাত এবং ভূমিধস আমাদের অতি পরিচিত দুর্যোগ। তাছাড়া সিসমিক জোনে অবস্থানের কারণে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা থেকেও আমরা ঝুঁকি মুক্তনই।
দুর্যোগের নিয়মিত ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও ষাটের দশক পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ধারণা ছিল মূলত ত্রাণ ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মানেই ছিল দুর্যোগ পরবর্তী পদক্ষেপ। ১৯৭০ সালে এ ভূখণ্ডে ঘটে যাওয়া ইতিহাসের অন্যতম মর্মান্তিক ঘূর্ণিঝড়ে ১০ লক্ষের অধিক মানুষ মারা যায়। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকদের বাঙ্গালীদের প্রতি মমত্ববোধের অভাব, বৈষম্যমূলক আচরণ এবং অত্যন্ত দুর্বল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কৌশল বাঙালি জাতির নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মর্মাহত করে।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের নির্বাচন, যা এদেশের মানুষের মুক্তির জন্য রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, নির্বাচনী প্রচার কাজ ফেলে বঙ্গবন্ধু ঘূর্ণিদুর্গত অবহেলিত মানুষের মাঝে ছুটে যান। তখনই তিনি দুর্যোগের পূর্ব প্রস্তুতিমূলক একটি ব্যবস্থার গুরুত্ব অনুভব করেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ধারণার প্যারাডাইম শিফটের সূচনা মূলতঃ সেখানেই।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ বা বন্ধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস ও প্রশমন করে তা যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে পারলে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। এজন্যই স্বাধীনতার পরপরই আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপকূলীয় বনায়নের মাধ্যমে সর্বপ্রথম দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রমের সূচনা করেছিলেন । ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের কাজও তখন থেকে শুরু হয়েছিল ।
[ বঙ্গবন্ধুই প্রথম দুর্যোগের পূর্বপ্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থার গুরুত্ব অনুভব করেন – মোঃ সেলিম হোসেন ]
সেসময়ে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচিকে তৎকালীন রেডক্রসের সহযোগিতায় সরকারের অন্যতম একটি কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল যা দুর্যোগ প্রস্তুতির ক্ষেত্রে আজও কার্যকর অবদান রাখছে। এ ধারাবাহিকতায় দুর্যোগ মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের লক্ষ্যে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ১৯৯৭ সালে দুর্যোগ বিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলী (এসওডি) জারি করা হয়। স্থায়ী আদেশাবলীতে (এসওডি) সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের সকল প্রতিষ্ঠান ও জনবলের দুর্যোগ মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। এস ও ডি ২০১৯ সালে হালনাগাদ ও সংশোধিত আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে দুর্যোগ দারিদ্র বিমোচনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্যোগ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্রিয়া—কলাপ গুলোর উপর দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব ফেলছে । এছাড়া দরিদ্ররা সম্পদ হ্রাস এবং কর্মসংস্থানের অভাব, আয়ের নিন্মগামীতা ইত্যাদি কারণে যেকোন ধরনের দুর্যোগের ক্ষেত্রে অধিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ১৯৭০ এবং ১৯৯১ সলের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পরে বাংলাদেশ সরকার দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের নীতিমালা চালু করেছে এবং বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি হ্রাস করতে শহর এবং উপকূলীয় অঞ্চলে অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ করেছে।
১৯৮০ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া ২১৯ টিরও বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অধিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে । বাংলাদেশ সরকার এসব সমস্যা সমাধানে ও অর্থনৈতিক ক্ষতি কমাতে এবং জীবন বাঁচাতে পদক্ষেপ নিয়েছে । ইতিমধ্যে সরকার একটি দীর্ঘ—মেয়াদী ডেল্টা পরিকল্পনা—২১০০ প্রণয়ন করেছে । এই পরিকল্পনার আওতায় প্রাথমিকভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ টি হটস্পটে আনুমানিক ৩৭.৫ মিলিয়ন ডলারের ৮০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে । পরিকল্পনার প্রথম ধাপের ৬ টি হটস্পট হলো উপকূলীয় এলাকা, বরেন্দ্র এবং খরাপ্রবণ অঞ্চল, হাওড় বা জলাবদ্ধ এবং বন্যা প্রবণ এলাকা, পাহাড়ী এলাকা, নদী ও মোহনা অঞ্চল এবং আরবান এলাকাসমূহ।
হারিকেন, সুনামি এবং ভূমিকম্পের আঘাত দমন করার ক্ষেত্রে আমাদের কোনো হাত নেই । তবে আমরা যা করতে পারি তা হলো দুর্যোগের প্রভাব কমাতে প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সক্ষমতা বাড়াতে পারি। আমাদের কিছু অ্যাকশন প্রোগ্রাম থাকা দরকার যাতে শুধুমাত্র পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থাই থাকবে না বরং আরো দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপসমূহ অন্তর্ভুক্ত থাকবে । ভূমিকম্প বিপর্যয় ঝুঁকির তালিকায় ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে স্থান পেয়েছে । ভবনের ঘনত্ব, ত্রুটিপূর্ণ ভবন নির্মাণ, দুর্বল ইউটিলিটি পরিষেবা, এবং পুরানো ঢাকার ঘনবসতি এর অন্যতম কারণ।
ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম এবং সিলেটের মত ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলিতে বন্যা ও জলাবদ্ধতা, ভূমিকম্প এবং অগ্নিকাণ্ডের মতো কারণে দুর্যোগ ও আপদ আসে। অস্থায়ী জনবসতি বা বস্তিবাসীদেরকে তাদের পরিবেশে বিদ্যমান সামাজিক, ফিজিকেল এবং অর্থনৈতিক দুর্বলতায় কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। সরকার দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২ প্রণয়ন করা হয়েছে।
—২—
আগামী ১৩ অক্টোবর বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় ও অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালিত হবে আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে “দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে সুশাসন নিশ্চিত করবে টেকসই উন্নয়ন” প্রতিবছর বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে সারাবিশ্বে অসংখ্য মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জনসংখ্যার একটা বিশাল অংশ মৃত্যুবরণ করে। টেঁকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে দুর্যোগ একটি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর বাংলাদেশেও বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ দেখা দেয়, যা দারিদ্র্য বিমোচনের অন্তরায়।
দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের মধ্যেই নিহিত আছে সম্পদের কয়ক্ষতি কমিয়ে আনার বীজ। এ উপলব্ধি থেকেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে প্রথম দুর্যোগ ঝুকি—হ্রাস কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার দুর্যোগ ঝুকি—হ্রাস এবং সারাদানে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
এর ফলে মানুষের মৃত্যু হার অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে যেকোন দুর্যোগে জীবন ও সম্পদের ঝুঁকি হ্রাস কল্পে নিয়ম বা বিধি বিধানের আলোকে অবকাঠামো নির্মাণ বিশেষ করে দুর্যোগ সহনীয় বাসগৃহ, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র, বহুমুখী মুজিব কিল্লা, ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার, জেলা ত্রাণ গুদাম কাম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তথ্য কেন্দ্র নির্মাণসহ গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার ও নির্মাণ কাজ অব্যাহত রয়েছে, যা এ বছরের প্রতিপাদ্যকে অর্থবহ করে তুলেছে।
আরও দেখুন: