[ADINSERTER AMP] [ADINSERTER AMP]

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা কবিতা রচনা করেছেন দুই বাংলার বহু কবি। তবে শুধুমাত্র বাংলাতেই নয় পৃথিবীর অনেক ভাষায় রচিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা। সেসব কিছু কবিতার সংগ্রহ নিয়ে আমাদের এই আয়োজন।

 

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা সূচি

 

বঙ্গবন্ধু – জসীম উদ্দীন

মুজিবর রহমান

ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারী বান।

বঙ্গদেশের এ-প্রান্ত হতে সকল প্রান্ত ছেয়ে,

জ্বালায় জ্বলিছে মহাকালানল ঝঞ্ঝা-অশনি বেয়ে।

বিগত দিনের যত অন্যায়, অবিচার-ভরা মার,

হৃদয়ে হৃদয়ে সঞ্চিত হয়ে সহ্যের অঙ্গার;

দিনে দিনে হয় বর্ধিত স্ফীত শত মজলুম বুকে,

দন্ধিত হয়ে শত লেলিহান ছিল প্রকাশের মুখে;

তাহাই যেন-বা প্রমূর্ত হয়ে জ্বলন্ত শিখা ধরি

ওই নামে আজ অশনি দাপটে ফিরিছে ধরণী ভরি।

 

মুজিবর রহমান

তব অশ্বেরে মোদের রক্তে করায়েছি পূত-স্নান!

পীড়িতজনের নিশ্বাস তারে দিয়েছে চলার গতি,

বুলেটে নিহত শহীদেরা তার অঙ্গে দিয়েছে জ্যোতি।

দুর্ভিক্ষের দানব তাহারে দেছে অদম্য বল,

জঠরে জঠরে অনাহার-জ্বালা করে তারে চঞ্চল।

শত ক্ষতে লেখা অমর কাব্য হাসপাতালের ঘরে,

মুহুর্মুহু যে ধ্বনিত হইছে তোমার পথের ‘পরে।

মায়ের বুকের ভায়ের বুকের বোনের বুকের জ্বালা,

তব সম্মুখ পথে পথে আজ দেখায়ে চলিছে আলা।

জীবন দানের প্রতিজ্ঞা লয়ে লক্ষ সেনানী পাছে,

তোমার হুকুম তামিলের লাগি সাথে তব চলিয়াছে।

রাজ ভয় আর কারাশৃঙ্খল হেলায় করেছ জয়

ফাঁসির মঞ্চে মহত্ত্ব তব কখনো হয়নি ক্ষয়।

বাংলাদেশের মুকুটবিহীন তুমি প্রমূর্ত রাজ,

প্রতি বাঙালীর হৃদয়ে হৃদয়ে তোমার তক্ত-তাজ।

তোমার একটি আঙুল হেলনে অচল যে সরকার

অফিসে অফিসে তালা লেগে গেছে – স্তব্ধ হুকুমদার।

এই বাঙলায় শুনেছি আমরা সকল করিয়া ত্যাগ,

সন্ন্যাসী বেশে দেশ-বন্ধুর শান্ত-মধুর ডাক।

 

শুনেছি আমরা গান্ধীর বাণী জীবন করিয়া দান,

মিলাতে পারেনি প্রেম-বন্ধনে হিন্দু-মুসলমান।

তারা যা পারেনি তুমি তা করেছ, ধর্মে ধর্মে আর,

জাতিতে জাতিতে ভুলিয়াছে ভেদ সন্তান বাঙলার।

তোমার হুকুমে রেল-জাহাজের চাকা যে চলেনি আর

হাইকোর্টের বন্ধ দরজা খুলিবে সাধ্য কার!

সেনাবাহিনীর অশ্বে চড়িয়া দম্ভ-স্ফীত ত্রাস,

কামান গোলার বুলেটের জোরে হানে বিষাক্ত শ্বাস ।

তোমার হুকুমে তুচ্ছ করিয়া শাসন-ত্রাসন-ভয়,

আমরা বাঙালী মৃত্যুর পথে চলেছি আনিতে জয়।

ধন্য এ-কবি এ-যুগে এখনো রয়েছে জীবন লয়ে,

সম্মুখে তার মহাগৌরবে ইতিহাস চলে বয়ে।

ভুলিব না সেই মহিমার দিন, ভাষার আন্দোলনে;

বুলেটের ভয় তুচ্ছ করিয়া ছেলেরা দাঁড়ায় রণে।

বরকত আর জব্বার আর সালাম পথের মাঝে,

পড়ে বলে গেল, “আমরা চলিনু ভাইরা আসিও পাছে।”

উত্তর তার দিয়েছে বাঙালী জানুয়ারী সত্তরে,

ঘরের বাহির হইল ছেলেরা বুলেটের মহা-ঝড়ে!

পথে পথে তারা লিখিল লিখন বুকের রক্ত দিয়ে,

লক্ষ লক্ষ ছুটিল বাঙালী সেই বাণী ফুকারিয়ে ।

মরিবার সে কী উন্মাদনা যে, ভয় পালাইল ভয়ে,

পাগলের মত ছোটে নর-নারী মৃত্যুরে হাতে লয়ে।

 

আরো একদিন ধন্য হইনু সে মহাদৃশ্য হেরি,

দিকে-দিগন্তে বাজিল যে-দিন বাঙালীর জয়ভেরী।

মহাহুঙ্কারে কংস-কারার ভাঙিয়া পাষাণ দ্বার

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবেরে করিয়া আনিল বার।

 

আরো একদিন ধন্য হইব ধন-ধান্যতে ভরা,

জ্ঞানে-গরিমায় হাসিবে এদেশ সীমিত-বসুন্ধরা।

মাঠের পত্রে ফসলেরা আসি ঋতুর বসনে শোভি,

বরণে সুবাসে আঁকিয়া যাইবে নকসী কাঁথার ছবি।

মানুষে মানুষে রহিবে না ভেদ, সকলে সকলকার,

একসাথে ভাগ করিয়া খাইবে সম্পদ যত মার।

 

পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদীর রূপালীর তীর পরে

পরান-ভুলানো ভাটিয়ালী সুর বাজিবে বিশ্ব ভরে।

আম-কাঁঠালের ছায়ায় শীতল কুটিরগুলির তলে,

সুখ যে আসিয়া গড়াগড়ি করি খেলাইবে কুতূহলে।

 

আরো একদিন ধন্য হইব চির-নির্ভীকভাবে,

ওমরের মত নেতার পাগড়ি ধরিয়া জবাব চা’বে।

“কোন্ অধিকারে জাতির স্বার্থ করিয়াছ বিক্রয়?”

আমার এ-দেশ হয় যেন সদা সেইরূপ নিৰ্ভয়।

 

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে – মুহম্মদ নূরুল হুদা

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমিই ৭ই মার্চ, ঊনিশশ একাত্তর।
এই মরলোক যদিও আমার দৃশ্যমান আঁতুরঘর,
অনন্তকালের অনন্তলোকে আমি অনন্তঅমর।
আমার মানবসূত্র চিরজীবিত বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিবর।

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, বঙ্গবন্ধুবাঙালির জাতির জনক;
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, জাতিমুক্তির পাঠ নিয়ে
বিশ্বকে তিনি দিয়েছেন মানবমুক্তির সুষম সবক।
‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়?’
মুক্তপৃথিবীর মুক্তমানুষ আজ অবাক তাকায়
জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের লালসবুজ পতাকায়।

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,
৭ই মার্চের স্বাধীনতামঞ্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা,
বিশ্বব্যাপী জাতিরাষ্ট্রের শৃঙ্খলমুক্তির প্রমিত প্রণোদনা।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,
৭ই মার্চের সংগ্রাম বিশ্বব্যাপী সব মানুষের মুক্তির সংগ্রাম;
৭ই মার্চের সংগ্রাম সকল জাতিরাষ্ট্রের স্বাধীনতার সংগ্রাম।

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,
আমি অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের বিবর্তনপ্রবণ নবায়ন;
কাল থেকে কালান্তরে আমি ত্রিকালজ্ঞের ত্রিবেণী-সঙ্গম;
আমি বিশ্বের তাবৎ প্রাণী ও প্রাণসত্তার প্রমূর্ততার প্রতীক:
আমি মহাকালের মহাঘড়ি; আমি বেজে চলেছি টিকটিক।

আমি বাংলার জয়, বাঙালির জয়; আমি চিরকাল শুভসময়।
মহাবিশ্বের মহামানবের মহাকালের জয়, আমি মানবসময়।

 

মার্চ – কামাল চৌধুরী

আকাশে বাতাসে মার্চের বরাভয়
মার্চ এসে গেছে জনতার চিৎকারে
প্রতিবাদী দেশ, প্রতিবাদী জনগণ
মার্চ এসে গেছে বাংলার ঘরে ঘরে।

মার্চ এসে গেছে হাজারো নদীর ¯্রােতে
নৌকোজীবন, লৌকিক সাম্পানে
পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদীর তীরে
মার্চ এসে গেছে মহামুক্তির গানে।

আমার ঠিকানা নদ-নদীদের দেশে
পিতৃপুরুষ বাঙালি মাছে ও ভাতে
তবুও আমার শ্যামল শরীর রাগী
মার্চ এসে গেছে শব্দিত পদাঘাতে।

মার্চ এসে গেছে প্রতিরোধী লাঠি হাতে
সবুজে ও লালে মানচিত্রের রোদে
দুহাতে নতুন প্রাণের পতাকা নিয়ে
মার্চ এসে গেছে কোটি মানুষের ক্রোধে।

মার্চ এসে গেছে রেসকোর্স মাঠে আজ
লক্ষ জনতা; ভয় কী বন্ধু জাগো
মুজিব নামের রাখাল বাজার ডাকে
স্বাধীন পতাকা উড়ছে আকাশে মাগো।

মার্চ এসে গেছে শেখ মুজিবের নামে
মার্চের ভাষা সাহসের তর্জনী
জনসমুদ্রে স্বাধীনতা স্বাধীনতা
আকাশে বাতাসে জয়বাংলার ধ্বনি।

ওরা ভেবেছিল হত্যাই শেষ কথা
পাকি হানাদার গণহত্যায় মাতে
রুমি নজরুল লাখো শহিদের খুনে
মার্চ এসে গেছে যুদ্ধ অস্ত্র হাতে।

এই মার্চ মানে মুক্তি ও স্বাধীনতা
এই মার্চ মানে বাঙালির জয়গান
স্বদেশ আমার, সাহসে ও সংগ্রামে
আমরা সবাই মার্চের সন্তান।

 

ডাকিছে তোমারে – সুফিয়া কামাল

এই বাংলার আকাশ-বাতাস, সাগর-গিরি ও নদী

ডাকিছে তোমারে বঙ্গবন্ধু ? ফিরিয়া আসিতে যদি

হেরিতে এখনও মানবহৃদয়ে তোমার আসন পাতা

এখনও মানুষ স্মরিছে তোমারে, মাতা-পিতা-বোন-ভ্রাতা।

 

যত অসহায় অক্ষম আর উপেক্ষিতরা সব

করুণ নয়নে হেরিছে এ-দেশে বিলাসের উৎসব

শূন্য উদরে সুরম্য পথে চলিতে চলিতে তারা

ভাবিছে তোমার এ-দেশে আবার আসিয়া বসিল কারা?

 

তোমার জীবন যৌবন ভরি সুদীর্ঘ কারাবাস

মুক্ত করিল, স্বাধীন করিল মুক্তির নিশ্বাস

ত্যাজিয়া মানুষ বাংলার মাটি বাংলার এ-বাতাসে

তোমারই দেওয়া মুক্তির বাণী জীবনের আশ্বাসে

গাহিয়া উঠিল গান

তোমার বিহনে ব্যাহত হয়েছে লক্ষ মানব প্রাণ।

 

বাংলার গান, বাংলার ধান, বাঙালীর খাদ্যকণা

লুট হয়ে যায়, বিনিময়ে তার আসিছে নকল সোনা।

জাহাজ আসিছে, আসে সম্ভার যত মেকি ঝলমল

সোনা চলে যায় সাগরের পাড়ে আবার গূরুন্দল

 

বাংলার বুকে হানা দিয়ে আসে, তোমার বজ্রস্বরে

সেই মূষিকেরা লুকাইয়া ছিল অন্ধ গুহার ঘরে

তারা আসে আজ, তোমার আওয়াজ ধ্বনিবে না আরবার

যত বেঈমান এই বাংলারে করেছিল ছারখার

দিবস রাতে দস্যুর দল হানা দিয়ে ঘরে ঘরে

নিত্যই দেখি এখানে-সেখানে মৃতদেহ আছে পড়ে

তোমার শোণিতে রাঙানো এ-মাটি কাঁদিতেছে নিরবধি

তাইত তোমারে ডাকে বাংলার কানন, গিরি ও নদী।

১৯৭৫

 

ধন্য মানুষ শেখ মুজিব – এম. এ. সোবহান

 

জাতির পিতা মহান নেতা সালাম তুমি লও

বিশ্বপিতার আশিস বরে দীর্ঘজীবী হও।

দুস্থ-দুখী ভুখা-নাংগার নিশানবরদার

নির্যাতিত মানবতার তুমি হে সরদার।

তোমার ডাকে জোয়ার জাগে মেঘনা-যমুনায়

পদ্মানদীর উতল পানি কলকলিয়ে ধায়।

শহর-গাঁয়ে, হাট-বাজারে সবার ঘরে ঘরে

তোমার কথা তোমারি নাম সবে স্মরণ করে।

জনতা আর দুঃখী মানুষ বাঁচার বাসনায়

অকূলে পায় কূল-ভরসা, তোমার পানে চায়।

তুমি দেশের সবার প্রিয় নেতা মহান বীর

হাজার দুখে, ভয়-বিপদে নোয় না তব শির।

 

তোমার ব্রত দুঃখীজনের দুঃখ মোচন করা –

পাষাণচাপা দুখের ভারে যেন না কাঁদে ধরা ।

‘বঙ্গবন্ধু’-র নামটি জাগে সবার আগেভাগে

ধন্য মানুষ শেখ মুজিবর খুশির গুলবাগে।

স্বাধীনতার জয়পতাকা উড়িয়ে দিলে তুমি

বিশ্বসভায় আসন পেলো স্বাধীন বাংলাভূমি।

তুমি সবার আশার আলো চোখের মণি-ধন

দেশ ও দশের ভালোর তরে জীবন করো পণ।

 

দেশকে গড়ে তুলতে আজ দুঃখ অভাব যতো

বরণ করে নেবার কথা বলছো অবিরত

দিচ্ছো অভয় দুখের নিশি কাটবে অচিরেই

সোনার বাংলা হবে এ-দেশ সবার সুখেতেই।

ডাক দিয়েছো সবারে আজ খেত-খামারে যাও

চাষের দেশে চাষাবাদের উন্নতি-গান গাও।

দেশকে সবে বাসলে ভালো লাগলে কাজে মন

ভাত-কাপড়ের অভাব কোন রইবে না তখন।

 

ইতিহাসের মহানায়ক উদয় মহাপ্রাণ

কেমন করে ভুলবে কেবা তোমার মহাদান?

তুমি দেশের মান বাঁচালে আনলে স্বাধীনতা

সবায় দিলে বাঙালী-বোধ দেশের জাতীয়তা

বাংলাদেশের বাঙালী সব ‘সোনার বাংলা’ গড়ে

স্বপ্ন তোমার করবে পূরা সকল দুঃখ হরে।

স্বাধীনতার তরে যে দেশ সামনে আগুয়ান

কমসে কম তিরিশ লাখ শহীদ করে প্রাণ

খুনরঙিন পোশাক পরে লড়াই করে আর

শপথ নেয় ভাঙবে বলে দুখের কারাগার

মুক্তিপথের বীরবাহিনী ছিঁড়তে রাহুগ্রাস

রক্তলেখায় লিখে তাদের জীবন ইতিহাস।

 

তুমি মহান রাষ্ট্রনায়ক–এইতো বাংলাদেশ

তোমায় পেয়ে গর্বিত যে পরে স্বাধীন বেশ।

জনতা আর জাতিরে আজ নব দিশার পথে

হাঁকাও জোরে নতুন সুরে নববিজয় রথে।

অকুতোভয় প্রাণের জোরে ঘোর তুফানে হাল

তুমিই জানি ধরতে পারো ছিঁড়ে ভয়ের জাল।

তোমার মহাপ্রজ্ঞা-বিচার সঠিক পথে

আসে জনতা পায় পথের দিশা খোশ-খবরে হাসে।

কতো কঠিন সংগ্রামেরে জয়ের পথে নিলে

বিজয়ী বীরবেশে সবার সামনে দেখা দিলে।

পিছিয়ে-পড়া হঠকারিতা স্বভাব তব নয়,

আসল খাঁটি সফল নেতা ভয়কে করো জয়।

অগ্নিদাহে খাঁটি সোনার পরীক্ষারি মতো

প্রমাণ দিয়ে দেখালে রূপ তব জীবন ব্রত।

 

‘আগরতলা’, ‘মিয়ানওয়ালা’ বন্দীখানার বেড়া

জনতা-মন প্রার্থনাতে রইল কি ঘেরা ?

মুক্ত হয়ে দেশে আবার এলে তুমি হলো

হাল ধরেছো জাতির নামে দেবে উজান পাড়ি

দেশ-জনতা তোমার সাথে নায়েরি দাঁড়ি।

আসুক যতো তুফান-ঝড় ভয়-বা কিসে আর

ধন্য মানুষ নেতা মোদের মুজিব কর্ণধার।

১৯৭২

 

১৫ আগস্টের এলিজি – শওকত ওসমান

“Here is mourning Rome, a dangerous Rome” “Shakespeare [“এই শোকতুর রোম, বিপদজ্জনক রোম” – ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকে সিজার-হত্যার পর মার্ক আ্যস্টনির উক্তি। ]

ইতিহাস নয়

অদৃষ্টের পরিহাস,

তোমার ঘাতকেরা আজ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান,

তোমার ঘাতকেরা আজ

নিজেদের সেবক রূপে জাহির করে।…

উপনিবেশ পূর্ব পাকিস্তান

তার মাথার উপর ডান্ডা ঘোরাতো।

ব্যারাক-নির্মিত যে সৈন্যদল

তাদের পদলেহী

দাস মনোবৃত্তির চরমতম জঘন্য প্রকাশ

নরাধম প্রাণীর দল

চোরের মায়ের বড় গলা

এখন চিৎকাররত এই দেশের মানুষের,

তারা আসল হিতাকাঙ্ক্ষী

মিত্র, স্বজন।

 

এমন নির্লজ্জ বেহায়াপনার সমর্থকও

মেলে এই ভূখণ্ডে।

ইনসাফের তৌলদণ্ড

যাদের হাতে ন্যস্ত

তারা পর্যন্ত অন্ধ হয়ে যায়

ধর্মব্যবসায়ীদের আলখেল্লার ঝলকে।

অথবা

ইহ-জাগতিক ভরক্কির

শ্রীবৃদ্ধির আকর্ষণে ।

 

তখন বিবেকের অবলম্বনের জন্য

আর কোথায় বাড়াব হাত?

ইতিহাস নয়, অদৃষ্টের পরিহাস ছাড়া

আর কোন্ পরিচয় হতে পারে

এমন পটভূমির ?

তবে তোমাকে আশ্বাস দিতে পারি,

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান,

রবীন্দ্রপ্রেমিক ছিলে তুমি,

তাঁরই বাণী, ‘প্রতিকারহীন

মনুষ্যত্বের পরাভবকে চরম বলে

বিশ্বাস করা আমি অপরাধ মনে করি’

—আজ আমাদেরও সান্ত্বনা।

 

তোমার আর এক প্রিয় কবি

যে নজরুলকে তুমি কাছে এনেছিলে

শেষ বয়সে তাঁর সেবা-শুশ্রূষার জন্যে

তাঁকে ‘জারজ’, ‘শয়তান’,’ধর্মদ্রোহী’

ইত্যাদি গালাগালে সজ্জিত করেছিলো

 

যে স্যোশাল ফোর্স বা

সামাজিক চাপ-শক্তি

সেই অপশক্তির মুখে থুথু দিয়ে

আজ তিনি আমাদের ‘জাতীয় কবি,’

যথাসম্মানে বিভূষিত।

সেই স্যোশাল ফোর্স

রূপকথার রাক্ষসের মতো প্রাণপ্রাপ্ত

তোমাকে বিনাশের আয়োজনে

ব্যাপৃত ছিলো,

ইতিহাস সাক্ষী।

 

সেখানেই আমাদের সান্ত্বনা নিহিত,

তুমিও ফিরে আসবে বৈকি

যথামর্যাদায় সার্থকনামা, বঙ্গবন্ধু।

তাইত আজও দৈনন্দিন প্রাণ ধারণ করি।

তাইত আজ

তুলে নিয়েছি কণ্ঠে তোমার স্লোগান :

জয় বাংলা!

জয় বাংলা!!

 

সে নাম মুজিব – সিকান্দার আবু জাফর

পৃত মাতৃঅঞ্চলের প্রসন্ন আশ্রয়ে

সন্তানের কলকণ্ঠ ছিড়ে গেলে ভয়ার্ত বিস্ময়ে

থেমে গেলে হাতে হাতে খেজুর পাতার পাটি বোনা

দু’দণ্ড কৌতুক মেলে শঙ্খচিল অথবা ঘুঘুর কণ্ঠে

কয়টি নতুন গল্প শোনা

সদ্য ফোটা শাপলার পরিতৃপ্ত আত্মসমর্পণে

অঙ্কিত বিচিত্র ছবি মুছে গেলে পুকুরের নিটোল দর্পণে

কবরের শ্মশানের অকস্মাৎ লাঞ্ছনা যখন

বন্দি করে নিয়ে যায় ঘরে ঘরে

মূর্ছাহত বাঙালীর মন

তখন যে-নাম

পিতার বক্ষের মত নির্ভরতা

মেলে ধরে বলে –

ভয় নেই, কল্যাণের ধ্রুব পদতলে

চূর্ণ হবে অসত্য অশিব,

সে নাম মুজিব।

 

নিরন্তর অত্যাচার-শোষণের খাদে

আবর্তিত অন্ধকার নিষ্পেষিত মানুষের

ভীরু আর্তনাদে

নির্মেঘ দিনের চোখে স্বচ্ছ দৃষ্টি দুরূহ যখন

শেখানো পাখির ঠোঁটে নিরুপায়

 

হৃদয়ের মিথ্যা উচ্চারণ,

তখন যে নাম

বিব্রত কঙ্কাল-কণ্ঠে জীবনের লক্ষ জয়ধ্বনি

চোখে চোখে উদ্ভাসিত

প্রত্যয়ের দিগন্ত সরণী

ভয়ঙ্কর দানবের সমুদ্যত খড়ামুখে

দৃপ্ত ঋজুগ্রীব

সে-নাম মুজিব।

উদায়ুধ শাসকের সৃষ্ট অজুহাতে

সুমঙ্গল স্বর্গপুরী ক্লিন্ন হলে ধৃষ্ট অপঘাতে

ব্যর্থ হলে মর্যাদার মুখস্থ চেতনা

কণ্টকিত উপহাসে পরিদীপ্র চিত্তের বেদনা

মাতা-বধূ-ভগ্নিদের সহস্র সজ্জায়

প্রসাধিতা কুলনারী নিহত সম্ভ্রমে ছেঁড়ে

অভ্যাসের দ্বার

পশু আর মানুষের ব্যবধানে অস্পষ্ট যখন

মানুষ্যত্ব বিনাশের ষড়যন্ত্রে তবু তীব্র

বিদ্বেষের গরল সিঞ্চন।

তখন যে-নাম

আকণ্ঠ তমিস্রমগ্ন বাঙালীর

আলোক-নির্ভর

দীর্ণ বুকে প্রত্যাশার বজ্রকণ্ঠস্বর

ডেকে বলে মৃত্যু নেই, মানুষের

পুত্র চিরঞ্জীব

সে-নাম মুজিব।

 

আকাশ-বাতাস-আলো যে মুহূর্তে

রুদ্ধদ্বার খাচা

ধর্মের কবচ নিয়ে তখনইত অৰ্থহীন বাঁচা

বাঙালী হলেই বাঁচি, ওতপ্রোত বাঙলার

প্রাণের কল্লোলে

এবং শনাক্ত হই মানুষের প্রসন্ন আদলে

যাদের চোখের দীপে এই সব

অসংশয় দৃষ্টি উন্মোচন

তাদের আত্মার ভোজে যখন প্রান্তরে-পথে

শকুনের স্বেচ্ছা নিয়ন্ত্রণ,

তখন যে-নাম

ডেকে বলে প্রতি আত্বদানে

বাঙালীর ঘরে ঘরে বাঁচবে বাঙালী তার যথার্থ সম্মানে,

মৃত্যুমুখে জননীর কোন পুত্র-কন্যা নয়

আশক্ত নির্জীব

সে-নাম মুজিব।

 

স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো – নির্মলেন্দু গুণ

একটি কবিতা লেখা হবে, তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান ক্সসকতে : ‘কখন আসবে কবি?’

এই শিশুপার্ক সেদিন ছিল না,
এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না,
এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না।
তা হলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি?
তা হলে কেমন ছিল শিশু—পার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে,
ফুলের বাগানে ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি?
জানি, সেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত
কালো হাত। তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ

কবির বিরুদ্ধে কবি,
মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,
বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল,
উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান,
মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ…।

হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি,
শিশু—পার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে তুমি
একদিন সব জানতে পারবে; আমি তোমাদের কথা ভেবে
লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প।

সেদিন এই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর।
না পার্ক না ফুলের বাগান, এসবের কিছুই ছিল না,
শুধু একখন্ড অখন্ড আকাশ যেরকম, সেরকম দিগন্ত—প্লাবিত
ধু ধু মাঠ ছিল দুর্বাদলে ঢাকা, সবুজের সবুজময়।
আমাদের স্বাধীনতাপ্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিল

এই ধুধু মাঠের সবুজে।
কপালে, কব্জিতে লালসালু বেঁধে
এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক,
লাঙ্গল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক;
পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক।
হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত,
নিম্নমধ্যবিত্ত, করুণ কেরানি, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘুরে
আর তোমাদের মতো শিশু পাতা—কুড়ানিরা দল বেঁধে।

একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের: ‘কখন আসবে কবি?’
‘কখন আসবে কবি?’

শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিলো জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা,
জনসমুদ্রে জাগিলো জোয়ার সকল দুয়ার খোলা।
কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর
অমর কবিতাখানি:

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।

Leave a Comment