[ADINSERTER AMP] [ADINSERTER AMP]

বঙ্গবন্ধুর ভুবনে রবীন্দ্রনাথ

আজ ২২ শ্রাবণ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮০তম প্রয়াণ দিবস। ১৯৪১ সালের ৬ আগস্ট কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তার জীবনাবসান ঘটে। আগস্টের এ শোকের মাসে বাঙালির আরেক কৃতী পুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও আমরা হারিয়েছি। কবিগুরুর প্রয়াণ দিবসে আমাদের গভীর শোক ও শ্রদ্ধা।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুজনেই বিশ্বমানবতা ও বিশ্বশান্তির জন্য নিবেদিতপ্রাণ। গভীর অধ্যাত্মবিশ্বাসী এ দুই মহাপুরুষের চিন্তাভাবনা ও কর্মকাণ্ডে বাংলা ভাষা ও বাঙালির প্রতি ছিল অপরিসীম প্রেম। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুজনেই বাংলা ও বাঙালিকে বিশ্বের দরবারে সুমহান মর্যাদায় হাজির করেছেন—একজন সাহিত্য দিয়ে, অন্যজন রাজনীতি দিয়ে। ‘বাঙালি’ বলে যে জাতির কথা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সেই জাতিকেই আবিষ্কার করেন ‘সোনার বাংলায়’। যে বাংলাকে ভালোবেসে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি,’ আর বঙ্গবন্ধু সেটিকে ভালোবেসে ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে জাতীয় সংগীতে রূপ দিলেন।

বাঙালি জাতিকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে তোলার ক্ষেত্রে কবিগুরু ও বঙ্গবন্ধু দুজনেরই দৃষ্টিভঙ্গির সমধর্মিতা বিশেষভাবে লক্ষ করার মতো। সমাজকে পুনর্জাগ্রত, পুনর্সংগঠিত ও বাঙালি সমাজের ওপর নির্ভর করে জাতীয় জীবনের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের কথা দুজনেই ব্যক্ত করেছেন। জনসাধারণের শিক্ষা ও গ্রামের প্রতি আকর্ষণ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারা ও কর্মপ্রণালির মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। ১৯১৫ সালে কবিগুরু যখন শিলাইদহ থেকে পতিসরে যান, তখন সেখানে ‘পল্লী উন্নতির বিরাট পরিকল্পনা’ রূপায়ণের চেষ্টা করেন।

রবীন্দ্রনাথ তার স্বদেশী সমাজ গঠনের প্রারম্ভেই এ দেশের কৃষকজীবনে সমবায়ের মাধ্যমে পরিত্রাণের প্রয়োজনীয়তার পথ উপলব্ধিকরেন। তার নানা প্রবন্ধে ও পত্রাদিতে এ বিষয়ে উল্লেখ আছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘…দেশের সমস্ত গ্রামকে নিজের সর্বপ্রকার প্রয়োজনসাধনক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য কতকগুলি পল্লী নিয়ে এক-একটি মণ্ডলী স্থাপন করা দরকার, সেই মণ্ডলীর প্রধানগণ যদি গ্রামের সমস্ত কর্মের ও অভাবমোচনের ব্যবস্থা করে মণ্ডলীকে নিজের মধ্যে পর্যাপ্ত করে তুলতে পারে তবেই স্বায়ত্তশাসনের চর্চা দেশের সর্বত্র সত্য হয়ে উঠবে। নিজের পাঠশালা, শিল্পশিক্ষালয়, ধর্মগোলা, সমবেত পণ্যভাণ্ডার ও ব্যাংক স্থাপনের জন্য পল্লীবাসীদের শিক্ষা সাহায্য ও উৎসাহ দান করতে হবে। এমনি করে দেশের পল্লীগুলি আত্মনির্ভরশীল ও ব্যূহবদ্ধ হয়ে উঠলেই আমরা রক্ষা পাব। কীভাবে বিশিষ্ট পল্লী সমাজ গড়ে তুলতে হবে, এই হচ্ছে আমাদের প্রধান সমস্যা (রবীন্দ্র রচনাসমগ্র, প্রবন্ধ, সমবায় নীতি)।’

কবিগুরুর অনুরূপ চিন্তাভাবনা আমরা বঙ্গবন্ধুর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে প্রতিফলিত হতে দেখি। তিনি বলেছেন, ‘…সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ায় খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ৪৮)।’

বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের অগ্রসেনানী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর জীবনে কবিগুরুর প্রভাব ছিল অপরিসীম। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সুখ-দুঃখের সাথী রবীন্দ্রনাথ। যতবার জেলে গেছেন ততবারই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থাকত সঞ্চয়িতা। বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব বলেছেন, ‘প্রতিবারই জেলে যাবার সময় বঙ্গবন্ধু সঞ্চয়িতাটা হাতে তুলে নিতেন। কারাগারের নিঃসঙ্গতায় বঙ্গবন্ধুর জীবনের একমাত্র সঙ্গী ছিল সঞ্চয়িতা। বইটির গায়ে পড়েছিল জেলের সেন্সরের অনেকগুলো সিল। অনেক যত্নে রাখা সত্ত্বেও সঞ্চয়িতার কপিটা বহু ব্যবহারে পুরাতন হয়ে গিয়েছিল।’

বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত জীবনেও রবীন্দ্রনাথ যে কতদূর প্রভাব বিস্তার করেছিল, তা ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। বেগম মুজিবের মতে, “কবিগুরুর আসন বঙ্গবন্ধুর অন্তরের অন্তস্তলে। রাজনৈতিক জীবনের উত্থান-পতন দুঃখ-দৈন্য সর্বমুহূর্তে তাকে দেখতাম বিশ্বকবির বাণী আবৃত্তি করতে। ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে যেনো না করি আমি ভয়,’ অথবা ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’ প্রভৃতি গানের টুকরো তিনি আবৃত্তি করে যেতেন দুঃখ-দৈন্য-হতাশায় ভরা অতীতের সেই দিনগুলোয়।”

বঙ্গবন্ধুর রবীন্দ্রপ্রীতির কথা বলতে গিয়ে ১৯৭২ সালে বেগম মুজিব দৈনিক বাংলার সাংবাদিককে অত্যন্ত আবেগময় ভাষায় বলেন,

‘কোনো কারণে আমি মনোক্ষুণ্ন হলে অতীতে বঙ্গবন্ধু আমাকে কবিগুরুর কবিতা শোনাবার প্রতিশ্রুতি দিতেন। আজও শত কাজের চাপে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও এতটুকু সময় পেলেই সন্তানদের নিয়ে তিনি কাব্য আলোচনা করেন, আবৃত্তি শোনান পরিবারের লোকদের। রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর সময় একবার একজন বিশ্বস্ত লোককে দিয়ে আমি রবীন্দ্র রচনাবলির পুরো এক সেট কলকাতা থেকে আনিয়েছিলাম। ওর সামনে যখন উপহার হিসাবে বইগুলো উপস্থিত করলাম, খুশির আবেগে তিনি তখন বিহ্বল হয়ে পড়লেন। উজ্জ্বল চোখ দুটো তুলে একবার শুধু তাকালেন। সে চোখে ছিল শিশুর মতো তৃপ্তি আর প্রগাঢ় কৃতজ্ঞতা।’

বঙ্গবন্ধুর জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব এতটাই বেশি ছিল, আর তাই তো কথায়, বক্তৃতায় উপমা দিতেন কবিগুরুর রচনাবলি থেকে। এ রকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর আহ্বানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। প্রধানমন্ত্রীরূপে শপথ গ্রহণের কিছুক্ষণ পরেই জনৈক সাংবাদিক যখন বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেন, ‘স্যার, আজকের দিনে জাতির প্রতি আপনার বাণী কী?’

জবাবে চিরাচরিত হাস্যমুখে তিনি বলেন:

‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ভয় নাই ওরে ভয় নাই/

নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী দেশ ভারত সুদৃঢ় ও প্রত্যক্ষ সমর্থন জুগিয়েছে। শরণার্থীদের আশ্রয়দান, প্রবাসী সরকার গঠনে সহায়তা এবং মুক্তিবাহিনীর সংগঠন, সামরিক প্রশিক্ষণ ও সমরাস্ত্র দিয়ে ভারতের ভূমিকা ছিল প্রত্যক্ষ। আমাদের সেই দুর্দিনের সাথী ও আশ্রয়দাতা ভারতের মহান জনগণ ও সরকারের আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতা সফরে যান। কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ভারতের ইতিহাসের বৃহত্তম জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভারতবাসীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। কলকাতার ওই জনসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রসঙ্গ বারবার এসেছে।

ব্রিগেড প্যারেডের জনসভার সংবাদ তুলে ধরে ১৯৭২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় আনন্দবাজার পত্রিকায় সংবাদ শিরোনাম করা হয়, ‘দুই দেশকে অনুপ্রাণিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ’। এতে বলা হয়েছিল, “ভারত ও বাংলাদেশের অনুপ্রেরণা আজ রবীন্দ্রনাথ। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে তাই রবীন্দ্রনাথের কথা বারবার এসে পড়েছে। …জনসভায় রবীন্দ্রপ্রেমী শেখ মুজিবরের মুখেও রবীন্দ্রনাথের কবিতা। ভোজসভায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী [শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী] বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে [বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান] বলেন, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের দূরদৃষ্টি ও জীবনদর্শন আমাদের উভয়কেই অনুপ্রাণিত করেছে। তার বিরাটত্বের এটাই বড় প্রমাণ যে তিনি আমাদের ও আপনাদের জনগণকে সমানভাবে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। তার একটি ভবিষ্যদ্বাণীকে আপনারা সত্য প্রমাণিত করেছেন, ‘তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে’। এই মৈত্রী, সহযোগিতা ও নব নব ভাবধারার স্বর্ণদ্বার যেন অনন্তকাল ধরে খোলা থাকে।”

ওইদিনের জনসভাস্থলে সমবেত কণ্ঠে শুরুতে গাওয়া হয় ‘বাঁধ ভেঙ্গে দাও’ এবং সব শেষে ‘আমার সোনার বাংলা’ এবং ‘জনগণমন’—কবিগুরুর লেখা দুটি জাতীয় সংগীত, দুই প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্রের। শুরুতে বঙ্গবন্ধুকে শুধু কলকাতা ও ভারতের জনগণের পক্ষ থেকেই নয়, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের শিষ্য হিসেবেও ইন্দিরা গান্ধী স্বাগত জানিয়েছিলেন।

উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর সম্মানে কলকাতায় যে একটিমাত্র সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল, সেটিও রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা।

শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানার্থে দেয়া রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় যে রবীন্দ্রসংগীত বাজানো হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর, যে রাতে মোর দুয়ারগুলি, ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’ ইত্যাদি অমরজয়ী রবীন্দ্রসংগীত।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করেন। সেদিন পাকিস্তনের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে রেসকোর্সের ময়দানে লাখ লাখ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে কবিগুরুর সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন

‘সাত কোটি বাঙালিকে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি’র বিপরীতে অশ্রুভেজা কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘কবিগুরু তোমার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’

রবীন্দ্র গবেষকরা মনে করেন এর থেকে বড় শ্রদ্ধার্ঘ্য কবিগুরুর প্রতি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কের আর কী হতে পারে?

বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি যতদিন থাকবে, ততদিন এ দুজন আমাদের আলোর দিশারি হয়ে থাকবেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ এক বিশাল পরিপূর্ণ হূদয় দিয়ে তিনি মানবকল্যাণের প্রতি গভীর মমত্ববোধ তার জীবনবোধের মধ্য দিয়ে পরস্ফুিট করে তুলেছেন।

Leave a Comment