বঙ্গবন্ধুর সরকার – বাজেট প্রণয়ন ও কর নির্ধারণ

বাজেট প্রণয়ন ও কর নির্ধারণ – বঙ্গবন্ধুর সরকার : অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাজেট একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল। বাজেটের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সরকারের একটি নির্দিষ্ট সময়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব এবং অর্থনৈতিক কার্যাবলি এবং রাজস্বনীতির প্রতিফলন ঘটে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের (১৯৭২-৭৫) সাড়ে তিন বছর সময়ে চারটি বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছিল। এর তিনটি উপস্থাপন করেছিলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এবং একটি উপস্থাপন করেছিলেন ড. আজিজুর রহমান মল্লিক।

বাজেট প্রণয়ন ও কর নির্ধারণ, Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman
Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman

বাজেট প্রণয়ন ও কর নির্ধারণ

উক্ত সময়ে চারটি বাজেপ উপস্থাপন করলেও বাজেট বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলেন তিনটি। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য অর্থমন্ত্রী বাজেটগুলো তৈরি করেছিলেন অত্যন্ত সুন্দর ও পরিচ্ছন্নভাবে। বাজেটগুলোর মূল বৈশিষ্ট্য ছিল দেশের অর্থ তিক অবস্থা অনুকূল বা প্রতিকূল যাই হোক না কেন পরিষ্কারভাবে জাতির সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা বঙ্গবন্ধু পরবর্তী সরকারগুলোর ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় না।

উদাহরণস্বরূপ ১৯৭৩ সালের ১৪ জুন ১৯৭৩-৭৪ সালের বাজেটে মাননীয় অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন:

“গত এক বছরে সকল দ্রব্যের তীব্র মূল্য বৃদ্ধি দেশের প্রতিটি মানুষকেই স্পর্শ করেছে। কেন এরকম মূল্যবৃদ্ধি হলো এবং মূল্যবৃদ্ধি রোধ করার জন্য সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, তা খুটিয়ে দেখা দরকার। কিন্তু সেই সঙ্গে গত এক বছরে দেশকে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে তার বাস্তবানুগ বিশ্লেষণ করা অপরিহার্য।”

এর সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণের জন্য ২০০২-২০০৩ অর্থবছরে বাজেটের ২ নং প্যারা থেকে কিছুটা উল্লেখ করা হলো “জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণায় পরিচালিত আমাদের সরকারের মূল উদ্দেশ্য হলো দেশ ও জনগণের সার্বিক কল্যাণ সাধন। এ লক্ষ্যে বিএনপি সরকারের বিগত শাসনামলে আমরা উন্নয়নমুখী ও স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়তে যে সকল কার্যকর ও যুগোপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলাম তার ফলে বিশ্ব অর্থনৈতিক মানচিত্রে বাংলাদেশ “Emerging Tiger” হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে । কিন্তু বিগত আওয়ামী শাসনামলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনুসৃত পশ্চাদমুখী নীতি ও অদূরদর্শিতার জন্য “Emerging Tiger”-এর ইমেজ সম্পূর্ণরূপে স্নান হয়ে যায়।”

প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৫-৭৬ সাল থেকে ২০০১-০২ পর্যন্ত দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কী ছিল বা কতটা উত্থান-পতন হয়েছিল তা অনেকটাই আমাদের জানা। সেই প্রেক্ষিতে ২০০২-০৩ অর্থবছরের বাজেটের উক্তি এবং ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরের বাজেটের উক্তি বিশ্লেষণের এটিই প্রমাণিত হয় তৎকালীন বাজেটগুলো ছিল বেশ স্বচ্ছ এবং দেশের আর্থিক অবস্থার এক প্রতিচ্ছবি।

বঙ্গবন্ধু সরকার বাজেট তৈরিতে দরিদ্র মানুষের যাতে খুব একটা কষ্ট না হয় বা দরিদ্র মানুষ যাতে উপকৃত হয়, সে বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন গুরুত্ব সহকারে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সরকারের আর্থিক অনটন সত্ত্বেও সরকার সাধারণ গরিব মানুষের কর ভার লাঘব করার লক্ষ্যে সকল প্রকার সুতি বস্ত্রের ওপর বিদ্যমান শতকরা ৫০ ভাগ আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করেছিলেন। ৭০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় কমে যাবে জেনেও দরিদ্র কৃষকের সুবিধার কথা বিবেচনা করে ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দিয়েছিলেন।

Sheikh Mujibur Rahman, the Prime Minster of Bangladesh, affixes his signature to the Constitution on November 1974
Sheikh Mujibur Rahman, the Prime Minster of Bangladesh, affixes his signature to the Constitution on November 1974

বঙ্গবন্ধু সরকারের বাজেটগুলিতে যে বিষয়টি বিশেষ লক্ষ্যণীয় ছিল, তা হলো নতুন করে করের বোঝা না চাপানো। যে কথাটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু দেশের গরিব মানুষের ওপর করের বোঝা চাপাতে মোটেও রাজি ছিলেন না।

রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে দেশের মানুষের যাতে কষ্ট না হয়, সে দিকে বঙ্গবন্ধু ছিলেন যথেষ্ট সজাগ। কর বিশেষ করে পরোক্ষ কর যেখানেই ধার্য করা হোক না কেন তার শেষ ভার দেশের সাধারণ গরিব মানুষের ওপর গিয়ে পড়ে। সম্ভবত সেই বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু কর ধার্যের ব্যাপারে ছিলেন যথেষ্ট সজাগ।

১৯৭৫ সালে ২৫ জানুয়ারি প্রথম জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনের দ্বিতীয় বৈঠকে বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন – কলে-কারখানায় কাজ করতে হবে। কাজ করে Production বাড়াও নিশ্চয়ই তোমরা তার অংশ পাবে । কাজ করবে না, আর পয়সা নেবে – তা হবে না কার পয়সা নেবে? গরিবের পয়সা নেবে? গরিবের উপর ট্যাক্স বসাব? খাবার আছে তার? কাপড় আছে তার? তার উপর ট্যাক্স বসাব কোত্থেকে? আমি পারব না। তোমাদের কাজ করে Production করে পয়সা নিতে হবে।

এই প্রসঙ্গে এটি উল্লেখ্য যে, ১৯৭৫ পরবর্তী প্রায় প্রতিটি বছরের বাজেটেই মোট রাজস্ব আয়ের শতকরা ৮০ ভাগের উপর সংগ্রহ করা হয়েছে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ করের মাধ্যমে কিন্তু ১৯৭৪-৭৫ সালের বাজেটে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কর মিলিয়ে মোট কর ধার্য করা হয়েছিল মোট রাজস্ব আয়ের শতকরা ৬৫ ভাগ এবং বাকি ৩৫ শতাংশ সংগ্রহ করা হয়েছিল অন্যান্য আয় থেকে।

বঙ্গবন্ধুর রাজস্ব আয় সংগ্রহের এই নীতি এটিই প্রমাণ করে যে দেশের পুনর্নির্মাণ এবং পুনর্গঠনের কাজে ব্যয়ের জন্য প্রচুর রাজস্ব আয়ের প্রয়োজন হলেও দেশের সাধারণ গরিব জনসাধারণকে যাতে করে অধিক করের বোঝা বহন করতে না হয় সে বিষয়টিকে লক্ষ্য রেখেই কর ধার্যের পরিধি নির্ধারণ করেছিলেন।

১৯৭২-৭৫ সালের বাজেটগুলোতে কর কতটা কম চাপানো হয়েছে তা শুধু ঐ সময়কালের বাজেট বিশ্লেষণ করলেই বোঝা সম্ভব নয় । এটা বুঝতে হলে প্রয়োজন ১৯৭৫ পরবর্তী সরকারের বাজেটগুলোর সাথে তার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা। ১৯৮০-৮১ সালের বাজেট যদি বিশ্লেষণ করা হয় বা ১৯৭২-৭৫ সময়কালের বাজেটের সাথে তুলনা করা হয়, তা হলে যে বিষয়টি স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায় তা হলো- বিভিন্ন পণ্যের ওপর অতিরিক্ত করারোপ। অতিরিক্ত করারোপের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব সংগ্রহ করাই যেন ছিল উক্ত বাজেটের (৮০-৮১) লক্ষ্য। বাজেটে বিভিন্ন স্থানে দরিদ্র মানুষের কথা বলা হলেও বাস্তবতার সাথে তা খুব একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয় না।

উদাহরণস্বরূপ ১৯৮০-৮১ সালের এক ব্যান্ডের রেডিওর ওপর আরোপিত শুল্ক প্রতি সেট ২০ টাকা থেকে বর্ধিত করে ২৫ টাকায় ধার্য করা হয় আবার ১৯৮১-৮২ সালে একই সরকার কর্তৃক ১৯ ইঞ্চির অনূর্ধ্ব পর্দাসম্পন্ন ও তদূর্ধ্ব পর্দাসম্পন্ন রঙিন টিভির ওপর আরোপিত সেট প্রতি যথাক্রমে ৪,৫০০ টাকা ও ৩,০০০ টাকা শুল্ক হারকে হ্রাস করে ৩,০০০ টাকা ও ২,০০০ টাকায় নির্ধারণ করা হয়। আবার সাম্প্রতিককালের বাজেটগুলোও যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে বাজেটে গরিব জনগোষ্ঠী উপেক্ষিত।

উদাহরণস্বরূপ ২০০৬-০৭ অর্থবছরে প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে ব্যক্তি কর দাতার কর সীমা ২০০৫-০৬ এর মতো ১ লাখ ২০ হাজার টাকা রাখা হয়েছিল । এই সঙ্গে ব্যক্তি করদাতার আয়কর নির্ধারণে আগের বছরের ধাপ ও হারগুলো অপরিবর্তিত রাখা হয়েছিল। আবার ন্যূনতম করের পরিমাণ অব্যবহিত আগের বছরের মতোই ১ হাজার ৮০০ টাকা ছিল। ২০০৫-০৬ অর্থ বছরে মূল্যস্ফীতি হয়েছে গড়ে প্রায় ৭ শতাংশ। সে হিসাবে মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে।

হিসাব কষে দেখা গেছে ২০০৫-০৬ অর্থ বছরের ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকার মূল্য ২০০৬-০৭ অর্থ বছরে দাঁড়িয়েছিল ১ লাখ ১১ হাজার ৬০০ টাকায়। এভাবে নিম্ন আয়ের ব্যক্তিকে, প্রকৃত আয় কম সত্ত্বেও পূর্বের হারেই কর প্রদান করতে হয়েছে পক্ষান্তরে যেসব করদাতা সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ হারে কর দিতেন তারা ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ১০ শতাংশ অতিরিক্ত আয় বৃদ্ধি দেখালে শুধু অতিরিক্ত এই আয়ের জন্য ১০ শতাংশ হারে রেয়াত পাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে উচ্চ আয়সম্পন্ন ব্যক্তিদের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল।প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা

২০০৬-০৭ অর্থবছরে অন্যতম পরোক্ষ কর ভ্যাটের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৪ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা যা পূর্ববর্তী বছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে প্রায় ১৯ শতাংশ বেশি। এক বছরের ব্যবধানে ১৯ শতাংশের বেশি পরোক্ষ কর ধার্য করা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় এটা গরিব মানুষের ওপর কতটা চাপ সৃষ্টি করতে পারে। একই বছরে বাজেটে ছোট কোম্পানির ক্ষেত্রে ব্যবসায় লাভ হোক আর লস হোক ন্যূনতম পাঁচ হাজার টাকা অথবা বিক্রয়ের ওপর ০.৫ শতাংশ এর মধ্যে যেটি বেশি তা আয়কর হিসেবে প্রদানের বিধান করা হয়েছিল।

এই বিধান আয়কর আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। আয়কর আইন অনুযায়ী আয় হলে তবেই কর প্রদান করতে হয়, অথচ এখানে বিধান করা হয়েছিল ব্যবসায় লোকসান হলেও কোম্পানিকে কর প্রদান করতে হতো। ২০০৬-০৭ অর্থবছর বাজেটে এরকম অসঙ্গতি ১৯৭৫-৭৬ পরবর্তী প্রায় প্রতিটি বছরেই লক্ষ্য করা যায়। বাজেটে রাজস্ব সম্পর্কিত এই সমস্ত অসঙ্গতিপূর্ণ বিষয়গুলো থেকে যেটি অনুমান করা যায় তাহলো শুধুমাত্র রাজস্ব বৃদ্ধিই যেন বাজেটের একমাত্র লক্ষ্য।

আর এগুলোকে যদি বঙ্গবন্ধু সরকার সময়কালীন বাজেটের সাথে তুলনা করা যায়, হলে সহজেই অনুমান করা সম্ভব উক্ত সময়কালীন বাজেট কতটা গরিব জনগোষ্ঠীর দিকে খেয়াল রেখে তৈরি করা হয়েছিল। বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বৈদেশিক এবং অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে এমন এক অবস্থায় বঙ্গবন্ধু দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন যখন রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যে অর্থ ছিল তা দিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বেতন দেওয়া সম্ভব ছিল না।

Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman
Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman

সেই অবস্থা থেকে দেশে ব্যাপক পুনর্গঠন পুনর্বাসনের কাজ করেছিলেন যার বর্ণনা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। এরূপ পুনর্গঠন, পুনর্বাসন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা থাকা সত্ত্বেও দেশের স্বার্থে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বৈদেশিক মুদ্রা গ্রহণকে খুব একটি প্রাধান্য দিতেন না। কারণ বৈদেশিক মুদ্রা মূলত শর্ত সাপেক্ষে প্রদান করা হয়। সকল শর্ত সবসময় দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য শুভ নাও হতে পারে। তাছাড়া বৈদেশিক ঋণের জন্য উচ্চ হারে সুদ প্রদান করতে হয়।

বৈদেশিক ঋণের সুদ আসল পরিশোধ ঋণ গ্রহণকারী দেশের জন্য একটি বিরাট বোঝা স্বরূপ। বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ফলে অনেক সময় দেশের ভবিষ্যৎ বংশধরদেরও ধরনের বোঝা বহন করতে হয়। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বংশধরদের যেন অধিক ঋণের বোঝা বহন করতে না সেজন্য বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু সরকারের আকাঙ্ক্ষা কম পরিলক্ষিত হয়।

এ ধারণার প্রমাণ পাওয়া যায়, বাংলাদেশ নৌবাহিনী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রামে ১০ ডিসেম্বর ১৯৭৪ তারিখে নৌবাহিনীর জোয়ানদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন “তোমাদের কমান্ডারের কাছে শুনেছি, তোমরা অনেক কষ্টে আছ তিনি বলেছেন তোমাদের প্রয়োজন অনেক। হ্যাঁ, সত্যিই অনেক প্রয়োজন। সবই তোমরা পাবে। কিন্তু আস্তে আস্তে। আমি বাংলাদেশকে বিক্রি করতে চাই না, মর্টগেজ রাখতে চাই না।

বিক্রি করলে বা মর্টগেজ রাখলে জিনিসের অভাব হয় না। কিন্তু আমি নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখে সাহায্য চাই। নিজেকে বিক্রি করে বা মর্টগেজ দিয়ে চাই না। আমি আস্তে আস্তে নৌবাহিনী গড়ব বঙ্গবন্ধু সরকারের সাড়ে তিন বছর সময়ে বাংলাদেশে প্রতিশ্রুত বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ১৮৬.২০ কোটি মার্কিন ডলার তার বিপরীতে ব্যয়িত বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৬.০ কোটি মার্কিন ডলার। ব্যয়িত ঋণের পরিমাণ ছিল প্রতিশ্রুতি ঋণের ৪৬.১৯%।

পক্ষান্তরে ১৯৭৪-৭৫ অর্থ-বছর পরবর্তী ৩৩ বছরের বিভিন্ন সরকারের সময় প্রতিশ্রুত বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৩২২০.১ কোটি মার্কিন ডলার এবং ব্যয়িত ঋণের পরিমাণ ছিল ২৬৩৭.১ কোটি মার্কিন ডলার। ব্যয়িত ঋণের পরিমাণ ছিল প্রতিশ্রুত ঋণের প্রায় ৮২%। এখানে আরও একটি তথ্য বিশেষভাবে উল্লেখ্য, তা হলো, যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের পুনর্বাসন, পুনর্গঠন ও উন্নয়ন কার্যক্রম করেও সরকার ১৯৭৪-৭৫ সালে বৈদেশিক ঋণের দায় সৃষ্টি করেছিলেন ৮৬৫ কোটি টাকা, যা ছির জিডিপি’র ১৭ শতাংশ।প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা

সেই অবস্থা থেকে শুধু প্রতি বছর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ঋণ গ্রহণ করে ২০০৪ সালে বৈদেশিক ঋণের বোঝা দাঁড়িয়েছে ৯৭ হাজার ৬২০ কোটি টাকা যা জিডিপি’র ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ। বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটে ২০০৬-০৭ অর্থবছর পর্যন্ত শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হতো কিন্তু ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে পর পর কয়েকটি বাজেটে সেটি আর সম্ভব হচ্ছে না, কারণ সুদ পরিশোধের পরিমাণ শিক্ষাখাতে বরাদ্দকৃত বাজেটের মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। এই অতিরিক্ত সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে উচ্চ ঋণের দায়ের জন্য। যে উন্নয়ন কাজের জন্য বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করে দেশের দায়ভার বাড়ানো হচ্ছে, সেই ঋণের টাকার যথাযথ ব্যবহার নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

দেশের রাজস্ব সংগ্রহে পরোক্ষ করের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭২ সাল থেকে অদ্যাবধি রাজস্ব বাজেটের সিংহভাগ আসে পরোক্ষ কর থেকে । তবে পরোক্ষ করের সবচেয়ে বড় দোষ হচ্ছে এর ভার সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ওপর অর্পিত হয় অতিরিক্ত পরোক্ষ করের চাপ দশের দরিদ্র কৃষক, শ্রমিক সবার প্রকৃত আয় কমিয়ে দেয়। পরোক্ষ করের এই কুফলের কথা বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধু সরকার খুব স্বল্প হারে এই কর আরোপ করেছেন ।

উদাহরণস্বরূপ ১৯৭৪-৭৫ সালে বাজেটে পরোক্ষ করের চাপ ছিল জিডিপি’র ৬.৭৫ শতাংশ। পক্ষান্তরে ২০০৬-০৭ সালে পরোক্ষ করের চাপ ছিল জিডিপি’র ১০.৫৩ শতাংশ। ১৯৭৪-৭৫ সালের তুলনায় ২০০৬-০৭ সালে পরোক্ষ করের বৃদ্ধির হার ছিল শতকরা ৫৬ ভাগ। এই অতিরিক্ত পরোক্ষ করের চাপ দরিদ্রের হার হ্রাস করতে বাধা সৃষ্টি করে।

২০০০-২০০১ থেকে ২০০৪-০৫ অর্থ-বছর পর্যন্ত দেশে প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৫.২৭%, ৪.৪২%, ৫.২৬%, ৬.২৭% এবং ৫.৯৬% অর্থাৎ গড়ে পাঁচ বছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫.৪৪% অথচ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দরিদ্র পর্যবেক্ষণ সমীক্ষা ২০০৪-এর তথ্য অনুযায়ী পূর্ববর্তী পাঁচ বছরে খাদ্যশক্তি গ্রহণ ভিত্তিতে দারিদ্র্য কমেছে গড়ে ০.৫ শতাংশ হারে। তার মানে উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার দারিদ্র্য হ্রাসের ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে না। প্রবৃদ্ধির ফসল চলে যাচ্ছে ধনীর কাছে। আরেক হিসাবে দেখা যায়, ১৯৭৩-৭৪ সালে মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ৬৫২ টাকা বা প্রায় ৮২ ডলার।

এরপর থেকেই দেশে মাথাপিছু আয় ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। আর বাংলাদেশ অর্থনীতি সমীক্ষা ২০০৬ অনুযায়ী মাথাপিছু আয় ২৯ হাজার ৯৮৬ টাকা বা ৪৫৬ ডলার । টাকা এবং ডলার দুই হিসাবেই ৩২ বছরে দেশের মাথাপিছু আয় অনেক গুণ বেড়েছে কিন্তু প্রকৃত আয় কোন শ্রেণির জনগণের কতটুকু বেড়েছে তা নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট প্রশ্ন। ২০০৪ সালে সরকারকে দেওয়া বেতন প্রতিবেদনেও সরকারি কর্মচারীদের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ার কথা স্বীকার করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ১৯৭৩-৭৪ অর্থ-বছরকে ভিত্তি বছর ধরলেও দেখা যায় দ্রব্যমূল্যের পরিমাণ যে হারে বেড়েছে, সে হারে সরকারি কর্মচারীদের বেতন ভাতা বাড়েনি ফলে তাদের জীবনযাত্রার মান কমে গেছে, তাদের প্রকৃত আয়ও কমেছে।

আরও পড়ুন:

বঙ্গবন্ধুর সরকার

Leave a Comment