বঙ্গবন্ধুর দর্শন, সমবায়ে উন্নয়ন – ইমদাদ ইসলাম : ৭ মার্চ ৪৯তম জাতীয় সমবায় দিবস। ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলাই বর্তমান সরকারের লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য দেশের সমবায়ীরা বিভিন্ন পেশা ভিত্তিক সমবায় সমিতি গঠন করে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মাধ্যমে আয়বর্ধক ও উৎপাদনমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সমবায় সমিতির সদস্যরা নিজেদের জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন।
সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী এবং বেকার জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের পরিবর্তন এবং জীবনযাত্রারমান উন্নয়নের অন্যতম সোপান হচ্ছে সমবায়। সমবায়ের এই মতাদর্শকে সামনে রেখে পৃথিবীর বহু দেশ নিজেদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত রেখেছে। দেশের পল্লী অঞ্চলের দারিদ্রমোচন, নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণ ও পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিসহ নারীর ক্ষমতায়নে সমবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে।
দরিদ্রমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী একটি পরীক্ষিত ও স্বীকৃত মাধ্যম হচ্ছে সমবায়। সমবায় অধিদপ্তরের আওতায় নিবন্ধিত সমবায় সমিতিগুলো দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতি, দারিদ্রমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ ও অর্থনৈতিক সংস্থা সমবায়কে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তবে একই বা অভিন্ন উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখে সমবেতভাবে কাজ করার নামই হলো সমবায়। সমবায়ের ইতিহাস অনেক পুরানো অনেকে মনে করেন সমবায়ের সূত্রপাত হয়েছিল ভারতবর্ষ থেকে।
[ বঙ্গবন্ধুর দর্শন, সমবায়ে উন্নয়ন – ইমদাদ ইসলাম ]
ভারতবর্ষে মৌর্য আমলে সমবায় সংগঠনগুলোর উদ্ভব হয়েছিল। তখন সেগুলো নগর জীবনে পণ্য উৎপাদনে জনমত তৈরির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। তবে কৃষি ঋণ সরবরাহের লক্ষ্যে ১৯০৪ সালে ইংরেজ আমলে কো—অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটি অ্যাক্ট এর মাধ্যমে আমাদের এ উপমহাদেশে সমবায় শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরোনো। স্যার পিসি রায় খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার রাড়লী গ্রামের দরিদ্র মানুষকে আত্মনির্ভরশীল করার উদ্দেশ্যে সমবায়ের আদর্শে উদ্ধুদ্ধ করে ছিলেন। বর্তমানে অর্থনীতির প্রায় সকল ক্ষেত্রে সমবায় কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
বর্তমানে দেশে প্রায় ০১ (এক) লাখ ৮০ (আশি) হাজার নিবন্ধিত সমবায় সমিতি রয়েছে যার সদস্য সংখ্যা ০১(এক) কোটি সাড়ে ১২ (বার) লাখেরও বেশি। এ সকল নিবন্ধিত সমবায় সমিতির ভৌত সম্পদ, বিনিয়োগকৃত আর্থিক সম্পদ, মজুদ তহবিল ইত্যাদির পরিমাণ প্রায় ০৬ (ছয়) হাজার ০৩ (তিন)শত কোটি টাকা। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় ১০ (দশ) লাখ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। সমবায় শুধু অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি সামাজিক আন্দোলন, সহযোগিতা ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। এর মাধ্যমে দারিদ্রমোচন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিবেশ রক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। সমবায়ের মূলমন্ত্র হচ্ছে “সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেক্ষে আমরা পরের তরে”।
আমাদের দেশের সমবায় সমিতিগুলো সাধারণত ০৭ (সাত)টি নীতিমালা মেনে চলে। এগুলো হলো স্বতঃস্ফূর্ত এবং অবাধ সদস্য পদ, সদস্যদের গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং তথ্য আন্তঃ সমবায় সহযোগিতা এবং সামাজিক অঙ্গীকার। সমবায় প্রতিষ্ঠা করা সহজ কিন্তু তার সফলতা নির্ভর করে ০৭ (সাত)টি শর্তের উপর। এগুলো হলো ঐক্যবদ্ধতা, বিশ্বস্ততা, স্বচ্ছতা, শৃঙ্খলা, গণতন্ত্র, সহযোগিতা ও সম্প্রীতি এবং সামাজিক নিরাপত্তা। জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী বিশ্বের ৩০০ কোটিরও বেশি মানুষ সমবায়ের মাধ্যমে জীবন নির্বাহ করে।
ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উন্নয়ন দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মানুষ। তিনি ১৯৭২ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন আয়োজিত সমবায় সম্মেলনে প্রদত্ত তার বক্তব্যে উল্লেখ্য করেছিলেন “আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে’— এ হচ্ছে আমার স্বপ্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে, গণমুখী সমবায় আন্দোলনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কেননা সমবায় পথ সমাজতন্ত্রের পথ, গণতন্ত্রের পথ।
সমবায়ের মাধ্যমে গরিব কৃষকরা যৌথভাবে উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানা লাভ করবে”। সমবায় ব্যবস্থার প্রতি বঙ্গবন্ধুর দুর্বলতা ছিল। তাই সমাজে সুবিধাবঞ্চিত গরিব কৃষক, শ্রমিক, তাঁতি, জেলে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ধনী জোতদার মহাজনদের হাত থেকে রক্ষার জন্য সংবিধান ১৩ ও ১৪ ধারায় সুরক্ষা দিয়েছিলেন। ১৩ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে রাষ্ট্রীয়, সমবায় ও ব্যক্তিখাতের মালিকানায় থাকবে উৎপাদনের উপায়সমূহ। আর ১৪ ধারায় বলা হয়েছে কৃষক, শ্রমিক ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক মুক্তির মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। তবে একই সঙ্গে ব্যক্তিখাত ও সমবায়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
দেশের সমবায় সমিতিগুলোর মধ্যে অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালের জাতীয় সমবায় পুরস্কারের জন্য ১০টি ক্যাটাগরীতে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত ০৯ (নয়)টি সমবায় সমিতি ও ০১ (এক) জন সমবায়ীকে নির্বাচন করা হয়েছে।
কৃষিভিত্তিক/সার্বিক গ্রাম উন্নয়নে আমিভিটা সমবায় মৎস্য ও কৃষি খামার সমিতি লি.খুলনা, সঞ্চয় ও ঋণদান/ক্রেডিট—এ তুমিলিয়া খ্রিস্টান কো—অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লি. ঢাকা, দুগ্ধ সমবায়ে দিবস চন্দ্র ঘোষ খুলনা, মহিলা সমবায়ে সততা মহিলা বহুমুখী সমবায় সমিতি লি.ঢাকা,বহুমুখী সমবায়ে নওগাঁ মাল্টিপারপাস কো—অপারেটিভ সোসাইটি লি. রাজশাহী, মৎস্য সমবায়ে চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতি লি. চাঁদপুর, মুক্তিযোদ্ধা সমবায়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা শহিদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার পুনর্বাসন বহুমুখী সমবায় সমিতি লি. ঢাকা, বিত্তহীন, ভূমিহীন সমবায়ে পূর্ববস্তি ভূমিহীন বহুমুখী সমবায় সমিতি লি.ঢাকা,যুব, বিশেষ শ্রেণি, তাঁতীসহ অন্যান্য পেশাভিত্তিক সমবায়ে, দি মেট্রোপলিটন খ্রিস্টান কো—অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লি. ঢাকা, কর্মকর্তা/কর্মচারী, পরিবহন শ্রমিক কর্মচারী সমবায়ে বাংলাদেশ পুলিশ কো—অপারেটিভ সোসাইটি লি.ঢাকা।
সরকারের অর্থায়নে ২০২০—২১ অর্থ বছরের এডিপিতে সমবায় সমিতির মাধ্যমে পরিচালিত বাস্তবায়নাধীন উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ—আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প (৩য় সংশোধিত), সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচি (সিভিডিপি)—৩য় পর্যায়, বঙ্গবন্ধু দারিদ্রমোচন প্রশিক্ষণ কমপ্লেক্স (বর্তমানে বাপার্ড), কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ এর সম্প্রসারণ, সংস্কার ও আধুনিকায়ন (সংশোধিত) প্রকল্প, অংশীদারিত্বমূলক পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প—৩য় পর্যায় (পিআরডিপি—৩) (সংশোধিত) (জুলাই/২০১৫ হতে জুন/২০২২), উত্তরাঞ্চলের দারিদ্রের কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ কর্মসূচি (২য় পর্যায়) (১ম সংশোধিত), গাইবান্ধা সমন্বিত পল্লী দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্প, পুষ্টি সমৃদ্ধ উচ্চ মূল্যে শস্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ কর্মসূচির (জানুয়ারি, ২০১৯—ডিসেম্বর, ২০২৩), বার্ডের ভৌত সুবিধাদি উন্নয়ন, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি আধুনিকায়ন, পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ)।
রংপুর স্থাপন প্রকল্প, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং আধুনিক নাগরিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত সমবায়ভিত্তিক বহুতল ভবন বিশিষ্ট পল্লী জনপদ নির্মাণ প্রকল্প (জুলাই, ২০১৪ হতে জুন, ২০১৮ পর্যন্ত), পানি সাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিস্তার এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ধানের ফলন বৃদ্ধি শীর্ষক প্রায়োগিক গবেষণা প্রকল্প, জামালপুরে পল্লী উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠাকরণ শীর্ষক প্রকল্প।
বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলার চর এলাকার বসবাসরত দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প, সৌর শক্তি নির্ভর সেচ পদ্ধতি ও এর বহুমুখী ব্যবহারের মাধ্যমে দ্বি—স্তর কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণ শীর্ষক প্রকল্প, কুড়িগ্রাম ও জামালপুর জেলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য হ্রাসকরণ শীর্ষক প্রকল্প, উন্নত জাতের গাভী পালনের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত মহিলাদের জীবনযাত্রার উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দুগ্ধ ও মাংস উৎপাদনের লক্ষ্যে গঙ্গাচড়া উপজেলায় ডেইরী সমবায় কার্যক্রম সম্প্রসারণ, প্রান্তিক।
ক্ষুদ্র কৃষকের শস্য সংগ্রহ পরবর্তী সহযোগিতার মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ, হাজামজা/পতিত পুকুর পুনঃখননের মাধ্যমে সংগঠিত জনগোষ্ঠীর পাট পঁচানো পরবর্তী মাছ চাষের মাধ্যমে দারিদ্র্যমোচন, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত চার এলাকায় সৌর শক্তি উন্নয়ন প্রকল্প, আলোকিত পল্লী সড়কবাতি প্রকল্প, সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়িঘাটে গুঁড়ো দুগ্ধ কারখানা প্রকল্প, চট্টগ্রামের পটিয়ায় দুগ্ধ কারখানা স্থাপন প্রকল্প, বৃহত্তর ফরিদপুরের চরাঞ্চলে গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন, চারণভূমি সৃজনও দুগ্ধের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিতকরণে দুগ্ধের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিতকরণে দুগ্ধ কারখানা স্থাপন প্রকল্প। এ সকল প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মোট ব্যয় হবে ১ লাখ ৭ হাজার কোটি টাকাও বেশি।
দেশ স্বাধীনের পূর্ববর্তী বছর ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১৩৮ ইউ এস ডলার। ১৯৯০ সালে ২৯৭ ডলার, ২০১৭ সালে ১,৬১০ ডলার, ২০২০ সালে ২,০৬৪ ডলার। মূলত সমবায়ের মাধ্যমে আয় — বৈষম্য দূর করে ন্যয়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। দেশের কৃষি, মৎস চাষ, পশু পালন, দুগ্ধ উৎপাদন, পরিবহণ, ক্ষুদ্র ব্যবসা, আবাসন, পুঁজি গঠন, নারীর ক্ষমতায়ন ও পল্লী উন্নয়নে সমবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। অন্য যে কোনো দেশের মতো উন্নয়নের পূর্ব শর্ত হলো জনগোষ্ঠীর সকল শ্রেণির নাগরিকের অন্তর্ভুক্তি অর্থাৎ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সুফল থেকে কেউ যেন বাদ না পড়ে। বাংলাদেশ ২০১৮ সালের ১৬ মার্চ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করে। বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বহুমাত্রিক উন্নয়নের ধারা সূচিত হয়েছে বাংলাদেশে। ইতিমধ্যে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা আদায় করছে।
আরও পড়ুন: