১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৪ সালের জাতীয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৪ সালের জাতীয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণঃ আমার প্রিয় দেশবাসী, সংগ্রামী অভিনন্দন ও সালাম গ্রহণ করুন। কাল ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় দিবস। শহীদের রক্তে রঞ্জিত সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর আত্মত্যাগ ও পরম আকাঙ্খায় মূর্ত এই দিনটি। আজ আমরা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করি সেই সব অকুতোভয় বীর শহীদ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের, যাদের জন্য সোনার বাংলা আজ ও্পনিবেশিক শাসন ও শোষণ থেকে মুক্ত।

 

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৪ সালের জাতীয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৪ সালের জাতীয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

 

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৪ সালের জাতীয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

উনিশশো একাত্বুর সালের ডিসেম্বর মাসের ষোল তারিখে আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা সংঘামের সমান্তি এবং অর্থনৈতিক মুক্তিযুদ্ধের শুরু । এই যুদ্ধে এক মরণপণ সংগ্রাম আমরা শুরু করেছি। এই সংগ্রাম অনেক বেশী সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য । তবে আমরা যদি এঁক্যবদ্ধ থেকে কঠোর পরিশ্রম করি এবং সৎ পথে থাকি তবে ইনশাআল্লাহ জয় আমাদের অনিবার্ধ।

সংগ্রামী বন্ধুরা আমার,

স্বাধীনতার উষালগ্নে কি নিয়ে, কোন অবস্থায় আমাদের যাত্রা আরম্ত হয়েছিল, তা আপনারা ভালভাবে জানেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে ধ্বংসন্তপের উপর দাড়িয়ে শূন্য হাতে আমাদের যাত্রা আরম্ভ হয় । আমাদের শুরু করতে হয়েছিল পাকিস্তানীদের রেখে যাওয়া খণের বোঝা মাথায় নিয়ে। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৪ সময়ের দিক থেকে মাত্র তিন বছর

। একথা সত্য যে, তিন বছর আপনাদের কিছু দিতে পারবো না, একথা আমি আপনাদের বলেছিলাম । কিন্তু তা সত্তেও দেয়ার খাতা একেবারে শূন্য পড়ে থাকেনি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য কোটি মণ খাদ্যশস্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামথী আমদানী করা ছাড়াও ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, শ্রমিক ভাইদের নিমনতম মজুরী বৃদ্ধি, বেতন কমিশনের .

 

সুপারিশ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন, পাটের নিম্নতর মূল্য বৃদ্ধি এবং প্রাইমারী প্রদান_এই জাতীয় কয়েকটি ব্যবস্থা, যা সরকার কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে হলেও কার্যকর করেছে। একই সাথে আমাদের দেশের বিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে শুধু পুনঃপ্রতিষ্ঠাই করা হয়নি, মীরপুর, নয়ারহাট, তরাঘাট প্রভৃতি স্থানে নতুন সেতু নির্মাণ করে দেশে উন্নতর সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। আপনারা নিশ্চই এটাও জানেন, যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মানের জরীপ কাজের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

কৃষি ও শিল্পে উৎপাদন বাড়তে শুরু করেছিল, খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কমানো সম্ভব হয়েছিল। দেশবাসীও শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধির কিছুটা ফল লাভ করতে শুরু করেছিল। শুধু তাই নয়, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের উপযোগী প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। সেনা, বিমান ও নৌ-বাহিনী, বি ডি আর, রক্ষী বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীকে নতুন করে গঠন করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে দেশ পুনর্বাসন পর্যায় শেষ করে প্রবেশ করেছিল পুনগঠনের নতুন দিগন্তে।

৭২-এর দীর্ঘস্থায়ী অনাবৃষ্টি, ৭৩-এর আঞ্চলিক বন্যা ও ঘুর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি সত্বেও দেশ যখন পুনর্গঠন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, ঠিক সেই সময়ে উপর্যুপরি দুটি বিপর্যয় নেমে এল প্রথমতঃ মুদ্রাক্ষীতি। তার ফলশ্রুতিতে আমাদের অত্যাবশ্যক আমদানী পণ্যের অবিশ্বাস্য হারে মূল্য বৃদ্ধি। অন্যদিকে আমাদের রফতানী পণ্যের মূল্য বিশ্ব- বাজারে এই সয়ে বৃদ্ধিতো পায়ইনি, বরং অনেকাংশে কমে গেছে। দ্বিতীয়তঃ এবারের/গ্রলয়্কারী বন্যা । যার ফলে ১৭টি জেলার ৪ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হল মারাত্মকভাবে । দশ লক্ষ টনের বেশী খাদ্যশস্য হল নষ্ট।

এই দুই বিপর্যয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। আমাদের জাতীয় পুনর্গঠন প্রচেষ্টা হয়েছে বিঘ্লিত। এই সাথে একদল নরপশু চোরাকারবারী, কালোবাজারী, মুনাফাখোর, মজুতদার ও ঘুষখোরের হীন কার্যকলাপ অবস্থার আরও অবনতি ঘটিয়েছে। বাংলাদেশে আজ তিনটি মহাবিপদ তথা তিন শক্রর মোকাবেলা করছে।

(১) মুদ্রাস্ফীতি যা আজ সারা বিশ্বে ভয়াবহ আকারে দেখা দিয়েছে, (২) প্রাকৃতিক বিপর্যয় তথা বন্যা এবং (৩) চোরাকারবারী, মুনাফাবাজ, মজুতদার ও ঘুষখোর-এই তিন শক্রর বিরুদ্ধে সরকারকে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে নতুন প্রতিরোধ সংগ্রামে । সেপ্টেম্বরে বন্যার তান্ডব শুরু হওয়ার পর থেকে ৫৭,০০০ লঙ্গরখানা খুলে প্রতিদিন 8৪ লক্ষাধিক লোককে খাবার সরবরাহ করা হয়েছে এবং কোন অঞ্চলে এখনও তা  অব্যাহত আছে।

হেলিকপ্টার থেকে নৌকা পর্যন্ত যখন যেটা পাওয়া গেছে, তাতে করেই এই তৈরী খাদ্য পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে বন্যাকবলিত মানুষের কাছে। বন্যার অব্যবহিত পরেই নতুন করে আবাদ শুরু করার জন্য সরবরাহ করা হয়েছে বীজ ও চারা । দেয়া হয়েছে কৃষি খণ, টেষ্ট রিলিফ, ওয়ার্কস প্রোগামের টাকা, পরণের কাপড় ও ওঁষধপত্র। আমাদের সাধ্যের কিছুই আমরা অবশিষ্ট রাখিনি। বাংলার মানুষের এই মহাবিপদের দিনে বন্ধুদের কাছ থেকে সাহায্যও আমরা পেয়েছি। মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে তীরা এগিয়ে এসেছেন।

কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এই সাহায্য নিতান্তই অকিঞ্রিতকর। আজ এ কথা বলতে আমার দ্বিধা নেই যে, মানবতার ডাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসার পরিবর্তে বিশ্বের কোন সংবাদপত্র যখন লক্ষ লোক অনাহারে মারা যাবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করছিল ও দুঃখী মানুষের জন্য উপদেশ খয়রাত করছিল, তখন বাংলাদেশ সরকার তথা এ দেশের মানুষ বিশ্বের বৃহত্তম ত্রাণ তৎপরতা চালিয়ে, অবস্থা আয়ত্তে আনার | চেষ্টা করেছে। সম্পদ নিতান্ত সীমিত হওয়া সত্তেও সুষ্ঠ ও সুচারু বিলি বন্টনের মাধ্যমে নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে আমরা সক্ষম হয়েছি।

প্রিয় বন্ধুরা

আমি আগেই বলেছি, তিন শক্রর বিরুদ্ধে নতুন এক প্রতিরোধ যুদ্ধে আমরা | নিয়োজিত। আজ বিশ্বব্যাপী মুদ্রান্ধীতির দরুন তেল, খাদ্যসামশ্রী ও ॥। অন্যান্য অত্যাবশ্যক পণ্য আমদানীর জন্য আমাদের ব্যয় করতে হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ । অন্যদিকে মুগ্রাস্ীতি তথা বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের | চক্রে অন্যান্য উন্নয়নকামী দেশের ন্যায় বাংলাদেশের রফতানী পণ্য উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছে না।

তাই দেশ-বিদেশের মুদ্রান্ধীতির মোকাবেলায় উৎপাদন বৃদ্ধি, মিতব্যয়িতা ও মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে আনা, ওয়েজ আর্নার স্কীমে পণ্য আমদানী তথা পণ্য সরবরাহ বৃদ্ধি ও সুষ্ঠু বিলি-বন্টনসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা আমরা করছিঃ  বাজারে ইতিমধ্যেই কোন ক্ষেত্রে এর শুভ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। খাদ্য আমদানী ব্যয়-হাসের জন্যও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

ঘাটতি পূরণের জন্য আভ্যন্তরীণ খাদ্য সংগ্রহের নীতি আমরা গ্রহণ করেছি, একথা আপনারা নিশ্চই জানেন। দেশের খাদ্য দেশে মজুত করে দুঃসময়ে ন্যায্য মূল্যে সরবরাহই এর প্রধান উদ্দেশ্য । কৃষক ভাইয়েরা এ ব্যাপারে যাতে সরকার নির্ধারিত মূল্য পান এবং কোন প্রকার হয়রানির সম্মুখীন তাদের না হতে হয়, তার প্রতি নজর রাখা হচ্ছে। তাই খাদ্য সংগ্রহ অভিযানকে সাফল্যমগ্ডিত করা প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের কর্তব্য ।

বাংলাদেশের  অফুরন্ত প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যাপক ব্যবহারের বিষয়টি আমাদের সক্রির বিবেচনাধীন। এই পথে আমরা বেশ কিছুটা অগ্রসরও হতে পেরেছি। প্রাকৃতিক গ্যাসের সাহায্যে একাধিক ফার্টিলাইজার য্যানটরী স্থাপনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশের সংগে আলাপ-আলোচনা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। . এই কারখানাসমূহে যে সার উৎপাদন হবে, তা দিয়ে শুধু দেশেই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে না, আমরা তা বিদেশেও রফতানী করতে পারব।

আমাদের দেশের উপকূলীয় এলাকার তেলের সন্ধান লাভের উজ্জল সম্ভাবনা রয়েছে। তেল অনুসন্ধান ও আহরণের জন্য আমরা ইতিমধ্যেই কয়েকটি বিদেশি তেল কোম্পানীর সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছি।মুদ্রাস্ফীতি পরেই আসে প্রাকৃতিক বিপর্যয় তথা বন্যার কথা। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য দুর্টি জিনিসের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন- সময় ও অর্থ। পাকিস্তানী শোষকরা ২৫ বছরের শাসন ও শোষণে এ ব্যাপারে কিছুই করেনি । বরং বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে বাংলাদেশের কীধে চাপিয়ে দিয়ে গেছে বিরাট খণের বোঝা ।

বাংলাদেশ সরকার বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য দীর্ঘ ও স্বল্প মেয়াদী ভিত্তিতে চেষ্টা করছেন। আমাদের নতুন প্রতিরোধ সখ্রামে সর্বশেষ ও সর্বপ্রধান শক্র চোরাকারবারী স্মোগলার), কালোবাজারী, মুনাফাবাজ ও ঘুষখোরের দল। মানুষ যখন অনাহারে মারা যায়, তখনও এই সব নরপণ্ডর দল বাংলার দুঃখী মানুষের মুখের গ্রাস অন্যত্র পাচার করে দিয়ে থাকে।

বিদেশ থেকে ধার-কর্জ, এমনকি ভিক্ষা, করে আনা পণ্য ও বাংলার সম্পদ মজুদের মাধ্যমে এরা মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলে । এদের কোন জাত নেই, নেই কোন দেশ। এই সব নরপশুদের উৎ্থাতে আমি আপনাদের সাহায্য ও সহযোগিতা চাই। সরকার ইতিমধ্যেই সামরিক বাহিনীসমূহ নিয়োগের মাধ্যমে সীমান্তে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছেন।

কিছু সংখ্যক চোরাচালানীকে গুলী করে হত্যাও করা হয়েছে। চোরাচালান অনেকাংশে বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। সীমান্ত প্রহরায় নিযুক্ত বাহিনী সমূহ ও সরকারী কর্মচারীদের নিয়ে সংসদ সদস্যদের নেতৃতে বিভিন্ন স্থানে এই উদ্দেশ্যে গঠন করা হচ্ছে গণকমিটি। চোরাচালান সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হলে চাই জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা । আমি আশা করি, জনগণ এ কাজে নিশ্চই এগিয়ে আসবেন। এ ব্যাপারে একটা সুখের বিষর এই যে, ভারত সরকারও চোরাচালান বন্ধের জন্য তাদের এলাকায় যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন।

 

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৪ সালের জাতীয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৪ সালের জাতীয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

 

এখানে মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক দু্কৃতকারীর কথা উল্লেখ না করে আমি পারছি না। রাতের অন্ধকারে সন্ত্রাস সৃষ্টিই তাদের প্রধান উপজীব্য। ৪ জন সংসদ সদস্যসহ তিন হাজার আওয়ামীলীগ নেতা, কর্মী ও নিরীহ গ্রামবাসীকে এদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। তারা জনগণের সম্পদ বিনষ্ট করে জনগণের দুঃখ-কষ্ট বৃদ্ধি করতেও দ্বিধা রুরছে না। সরকার তো দূরের কথা, কোন শান্তিপ্রিয় নাগরিকই এটা বরদাস্ত করতে পারে না। সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে জনগণের কোন কল্যাণ বা কোন সমস্যার সমাধান হয় না।

এ গন্থা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বহু আগেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এছাড়াও ক্ষমতাপ্রাপ্ত কিছু লোক দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাম্প ছড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের সে সুযোগ দেওয়া হবে না। বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান বাংলাদেশে ধারা বসবাস করেন, তারা সকলেই এ দেশের নাগরিক। প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা সম-অধিকার ভোগ করবেন।

প্রিয় দেশবাসী

বিগত একটি বছরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনন্য সাফল্য সম্পর্কে আমি বিশেষ কিছু বলতে চাই না। আপনারাই তার বিচার করবেন। শুধু এইটুকু বলব, জাতিসংঘে আজ বাংলাদেশ স্বীয় ন্যায়সঙ্গত মর্ধাদার আসনে অধিষ্ঠিত। জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন, ইসলামিক শীর্ষ বৈঠক ও কমনওয়েলথ- সর্বত্র বাংলাদেশ সম্মানিত এবং সমাদৃত। প্রতিবেশী প্রতিটি দেশ, বিশেষ করে.নিকটতম প্রতিবেশী ভারত ও বার্মার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত হদ্যতাপূর্ণ।

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা আমরা করেছি। এমনকি মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধের জন্য যাদের বিচার হওয়ার কথা ছিল, সেইসব যুদ্ধাপরাধীকেও আমরা মার্জনা করে দিয়েছি। বাংলার মানুষের এ বদান্যতা ও ওইদার্য ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। সাবেক পাকিস্তানের সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বাটোয়ারা এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানী নাগরিকদের ফিরিয়ে দেয়া।

আরব ভাইদের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্র উন্মোচিত হয়েছে, সম্ভাবনাময় এক নতুন দিগন্ত। দুর্দিনে তারা আমাদের পাশে এসে দীঁড়িয়েছেন। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সর্বনাশা বন্যার সময় তারা যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শুরু থেকেই বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান, শোষিত, নির্যাতিত মানুষের সাথে একাতুতা ও কারও প্রতি বৈরীতা নয়, সকলের সাথে বন্ধুত্বের যে নীতি অনুসরণ করে আসছে, আজ তা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।

সংগ্রামী ভাইয়েরা আমার,

একটি কথা আমি প্রায়ই, বলে থাকি। আজও বলছি, সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। শোষিত, নির্যাতিত ও লুণ্ঠিত বাংলাদেশের সমাজদেহে সমস্যার অন্ত নেই। এই সমস্যার জটগুলিকে খুলে সুখী ও দেশ গড়তে হলে দেশবাসীকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না । চরিত্রের পরিবর্তন না হলে এ অভাগা দেশের ভাগ্য ফেরানো যাবে কিনা সনরাম স্বজনপ্রীতি

, দূর্ণীতি ও আত্পরবঞ্চনার ঊর্ধ্বে থেকে আমাদের সকলকে আত্ম-সমালোচনা আত্মসংযম এবং আত্মশুদ্ধি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আপনি আপনার কর্তব্য দেশের ও দেশের জনগণের প্রতি কতটা পালন ড় বৃদ্ধিতে আপনারা কি নিদারুণ কষ্ট পাচ্ছেন। বিশেষ করে সীমাবদ্ধ আয়ের লোকদের দুঃখ-কষ্টে আমি অত্যন্ত ব্যথিত আমাদের পরকাততিক চেষ্টা সত্ত্বেও কয়েক হাজার লোককে আমরা অনাহারের কবল থেকে বাচাতে পারি, নি- এ সত্য স্বীকার করতে আমার কোন লজ্জা নেই।

কারণ আমি জানি, সীমিত সম্পদ সব্বেও একমাত্র আমরাই তখন এসএ হতভাগ্য মানুষের পাশে দাড়িযেছিলাম। সামান্য যা কিছু পেয়েছি, তাই নিয়ে এদের সেবায় এগিয়ে গিয়েছি। কিছু সংখ্যক ভাববিলাসীর ন্যায় ব্তৃতা বিবৃতির ঝড় তুলেই ক্ষান্ত হইনি। খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে অনাহারে মৃত্যুর পুনরাবৃত্তি রোধ করার সুকঠিন চ্যালেগ আমাদের গ্রহণ করতে হবে।

ভাইয়েরা আমার, জীবন ধারণের এই দুঃসহ সংগ্রামে অতীতের ন্যায় এবারেও আমি আপনাদের পাশে রয়েছি, ভবিষ্যতেও থাকব । আমাদের আজকের এই দুঃখ-কষ্ট যে নিতান্ত সাময়িক, সে সম্পর্কে আমি সুনিশ্চিত। এই বাংলায় সম্পদের কোন অভাব নেই। কিন্ত ভার সম্যব্যবহারের জন্য সময়ের প্রয়োজন।

আমরা যদি বাংলার এ সম্পদ বাংলার মাটিতে রাখতে পারি, সমাজতান্মিক বিলি-কটন ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে পারি এবং সকলে মিলে কঠোর পরিশ্রম করে কল-কারখানা ক্ষেতে- খামারে উৎপাদন বাড়াতে পারি, তবে ইনশাল্লাহ আমাদের ভাবী বংশধরদের শোষণমুক্ত সুখী ও সমৃদ্ধিশালী এক ভবিষ্যৎ আমরা উপহার দিতে পারবো। আসুন, ১৬ই ডিসেম্বরের এই পবিত্র জাতীয় দিবসে আমরা সকলে সেই শপথ গ্রহণ করি।

খোদা হাফেজ !

জয় বাংলা!

 

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৪ সালের জাতীয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৪ সালের জাতীয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

আরও পরুন :

Leave a Comment