২০ জানুয়ারি ১৯৭৫ । অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আয়োজিত ভোজ সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ

২০ জানুয়ারি ১৯৭৫, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আয়োজিত ভোজ সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণঃ _ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মহাত্মনবৃন্দ, ভদ্র মহোদয় ও মহিলাগণ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাদের দেশে আপনাদের প্রথম সফর উপলক্ষে আমি নিজে এবং বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে আপনাকে এবং আপনাদের পর্যটক দলের সদস্যদের স্বাগত জানাতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত। বাংলাদেশের জনগণ সর্বদাই অস্ট্রেলিয়ার জনগণ ও তাদের মহান নেতৃবৃন্দকে পরম শ্রদ্ধা ও প্রশংসার চোখে দেখে এসেছে।

 

২০ জানুয়ারিতে ১৯৭৫ সালের অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আয়োজিত ভোজ সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ
২০ জানুয়ারিতে ১৯৭৫ সালের অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আয়োজিত ভোজ সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ

 

২০ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালের অস্ট্রেলিয়ার ১৯৭৫ সালের অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণ নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে, এক সুকঠোর সংগামে লিপ্ত ছিল, সেই অমানিশার দিনগুলিতে এ দেশের জনগণ অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রভূত সহানুভূতি ও সমর্থন পেয়েছে। বলা বাহুল্য অস্ট্রেলিয়া কেবল বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ একটি মহান দেশ নয়। অস্ট্রেলিয়ার জনগণের উৎসাহ-উদ্দীপনা, সৃজনশীলতা, মহানুভবতা সর্বজন বিদিত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার মাঝেই অস্ট্রেলিয়ার এই মহান .গুণাবলি রয়েছে। স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে আপনাকে স্বাগত জানাতে পেরে আমি সত্যিই গর্বিত।

সম্প্রতি ডারউনিয়ন শহরের উপর যে ধ্বংসলীলা নামে, তাতে বাংলাদেশী জনগণ সবিশেষ মর্মাহত । খুব বেশি দিনের কথা নয়, আমরাও অনুরূপ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখিন হয়েছিলাম । সুতরাং অস্ট্রেলিয়ায় এই দুর্যোগের প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে, তা আমরা সম্পূর্ণরূপে অনুধাবন করতে পারি। ডারউনিয়নের এই সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিগ্রস্থ জনগণের প্রতি আমরা গভীরভাবে সহানুভূতিশীল ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপনি যে বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করেছেন_ সে সম্পর্কে আমরা অবহিত। এই এলাকার দেশসমূহের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়াকে বিজড়িত করে আপনি অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়া দেশ সমূহের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার ক্ষেত্রে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।

বলাবাহুল্য নীতির ক্ষেত্রে এটা সুদরপ্রসারী অভিবাদনযোগ্য পরিবর্তন ও আপনার দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতায় পরিচয়ও। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিশ্বের সর্বাপেক্ষা স্বল্উন্নত এলাকা । দেশ মাত্রই প্রগতি আমাদের পাশ কাটিয়ে গেছে। সাম্প্রতিক কালে দুর্ভাগ্য বশত এ অঞ্চল কতিপয় প্রধান প্রধান সংঘর্ষ এলাকায় রূপান্তরিত হয়েছে। এই দিনগুলির ক্ষতিপূরণ ও সমৃদ্ধি ও প্রগতি সুনিশ্চিত করার জন্য আমাদের সর্বাদিক প্রয়োজন শান্তি ও স্থিতিশীলতা ।

এই মহান লক্ষ্য অর্জনে জনশক্তি ও বৈশালিক সম্পদে সমৃদ্ধ অস্ট্রেলিয়া গুরুত্পূর্ণ ও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে। তা সত্যিই আনন্দের কথা, আপনাদের মহান দেশ এ দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশে আপনার এই সফর কেবল আমাদের দুটি দেশের মধ্যকার সম্পর্কের সুযোগ্যতর ও সু-দৃঢ় করবে না, বরং বৃহত্তর আঞ্চলিক সহযোগিতা, শান্তি ও সম্পর্ক স্থাপনের কাজে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি নিশ্চই অবগত আছেন যে, আমার দেশ এখন এক অতি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়া অতিক্রম করছে।

আমাদের যুদ্ধ বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনের কাজ সমাধা হওয়ার পূর্বেই কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আমাদের পুনর্গঠন প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করেছে। ১০৭২ সালের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কালেই লক্ষ লক্ষ উদা্ত পুনর্বাসনের কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার আগেই আমাদের শুষ্ক খরা পরিস্থিতির সম্মুখীন হইতে হয়। ফলে বিপুল পরিমান খাদ্যশস্য আমরা বিদেশ থেকে আমদানী করতে বাধ্য হই।

 

২০ জানুয়ারিতে ১৯৭৫ সালের অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আয়োজিত ভোজ সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ
২০ জানুয়ারিতে ১৯৭৫ সালের অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আয়োজিত ভোজ সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ

 

এই যে, বিশ্ব অর্থনীতির মুদ্রাস্ফীতি , খাদ্য শস্যসহ সকল প্রকারের ভোগ্য পণ্য, শিল্পে ব্যবহৃত কীচামালের অবিশ্বাস্য হারে মূল্যবৃদ্ধি এবং জাহাজে পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাওয়াতে আমাদের সম্পদের উপর এর দুঃসহ চাপের সৃষ্টি হরেছে। এ দু’বছরে আমাদের আমদানি ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পেলেও আমাদের রপ্তানি পণ্যের মূল্য আনুপাতিক হারে বাড়েনি। গত বছর আগষ্ট মাসে সর্বনাশা বন্যা আমাদের অসুবিধাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এই বন্যায় দেশের এক বিরাট এলাকা প্রাবিত হয়েছিল। এইসব ঘটনাবলি আমাদের উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে মন্থর করে দেয়।

এর ফলে আমাদের জনগণকে বিরাট দুঃখ কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে, এখনও তা অব্যাহত আছে। কিন্তু তাতে ওঁদার্যের কোন কারণ নেই। বাঙালী জাতি সাহস, ধৈর্য, ত্যাগ তিতীক্ষার সঙ্গে সঙ্গে এ সমস্ত মোকাবিলা করছে। বাঙ্গালীরা সুদীর্ঘ এবং গৌরবময় সাংস্কৃতির এতিহ্য সমৃদ্ধ একটি সুসংগঠিত জাতি। তারা কঠোর পরিশ্রমী ও দেশপ্রেমিক। অতীতে বহুদিন ধরে শোষণ ও বঞ্চনার স্বীকার আমরা হয়েছি। কিন্তু আমাদের অদম্য মনোবল তাতে কোনদিন ভেঙ্গে পরেনি।

আজ আমরা যে অর্থনৈতিক অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছি- তা নিশ্চই সাময়িক। কঠোর পরিশ্রম, আত্ম বিশ্বাস ও জাতি এইসব অসুবিধা কাটিয়ে উঠতে পারব । বিগত কয়েক বৎসরে অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে যেসব মুল্যবান সাহায্য আমরা পেয়েছি, তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশকে, তার উন্নয়নে, যেসব দেশ নিয়মিতভাবে সাহায্য দান অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে- অস্ট্রেলিয়া তাদের অন্যতম । এতে আমরা আস্বস্ত। আমাদের দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে যে, আগামী দিনগুলিতেও আমাদের কল্যাণের ব্যাপারে এই বন্ধুসুলভ আগ্রহ অব্যাহত থাকবে।

এই সাহায্য বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে অতি প্রয়োজনীয় হলেও আমরা এ সম্পর্কে সচেতন যে, আমার নিজেদের প্রচেষ্টার উপরই আমাদের ভবিষ্যত নির্ভরশীল। এই করেছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্জন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, শিল্পায়ন, জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষা প্রসারণের কর্মসূচিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়াছে। বাণিজ্য দবি-পাক্ষিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা সম্প্রসারণে আমরা অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। বিগত তিন বৎসরে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্কের যে অব্যাহত উন্নতি হয়েছে_ তাতে আমরা আনন্দিত।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাদের পাটজাত উপায় থেকে সর্বপ্রকারের আমদানি শুক্ক রোধ করে আপনি এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এই গঠনমূলক ও সহায়ক পদক্ষেপ গ্রহণ করে আপনি এটাই প্রমাণ করেছেন যে, আপনার সরকার উন্নয়নশীল দেশসমূহের অর্থনৈতিক উন্নতি ও আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে । আপনাদের সহানুভূতিশীল মনোভাব শুধু কথায় নয় কাজেই প্রতিফলিত । মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এটা পুনরুল্লেখ্য নিস্প্রয়োজন যে, শান্তি, প্রগতি উন্নতির পূর্বশর্ত।

১৯৭১ সালের ধ্বংসাত্মক সংঘর্ষের ফলে অদ্ভুত পরিস্থিতির মোকাবেলায় নিয়োজিত আমাদের দেশ। এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে গভীরভাবে অংগিকারবদ্ধ। এজন্যই বাংলাদেশ ধৈর্য্যের সাথে এই উপমহাদেশের স্থায়ী সমাধান সুস্থতার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, এই অঞ্চলের উত্তেজনা হাসের জন্য ইতিমধ্যেই আমরা কিছু গুরুতৃপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। দেশের বিরুদ্ধে মনোভাব ও যুদ্ধ অপরাধের স্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্তেও শান্তি ও এক্যের স্বার্থে আমরা যুদ্ধাপরাধের বিচারও প্রত্যাহার করেছি।

কিন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, পাকিস্তান আমাদের এই ওদার্যের এখনও অনুরূপভাবে কোন সাড়া প্রদান করে নাই। কতিপয় বিষয় স্বাভাবিককরণের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছে। এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- সাবেক পাকিস্তানের সম্পদের ন্যায় সঙ্গত ও সুষম বন্টন ও বাংলাদেশে অবস্থানরত ৬৩ হাজার পাকিস্তানি পরিবারের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রশ্ন । আমরা আশা করি, এ অঞ্চলের জনগণের কল্যাণের ব্যাপারে, শাস্তি ও মৈত্রী স্থাপনের গুরুত্‌ পাকিস্তান স্বীকার করবেন এবং গঠতান্ত্িক মনোভাব নিয়ে আমাদের উদ্যোগকে সাড়া দেবে।

দীর্ঘকালের ঘৃণা ও সংস্কৃতির কুফলে জর্জরিত এলাকায় শান্তি ও মৈত্রী স্থাপনের কাজে আমাদের প্রচেষ্টার বিশ্বের সকল শান্তিকামী দেশ আমাদের সমর্থক করবে সে সম্পর্কে আমার কোন সন্দেহ নাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, কমনওয়েলথ দেশ হিসাবে, অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশ বহু অভিন্ন এ্রতিহ্য এবং মূল্যবোধের অধিকারী। অস্ট্রেলিয়ার ন্যায়, বাংলাদেশও একটি শান্তিপ্রিয় জাতি, তাই এটা খুবই স্বাভাবিক যে, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমরাও ভারত মহাসাগর এলাকাকে-শান্তি এলাকায় পরিণত করার পরিকল্পনাকে সমর্থন করেছি।

এটা খুবই উৎসাহের কথা যে, বেনিয়াদের কাছ থেকে ভারত মহাসাগর এলাকীকে মুক্ত রাখার উদ্যোগের প্রতি অস্ট্রেলিরাও জমর্থন দান করেছে। এই অভিন্ন  ভষ্টিভির জন্যই শাভতি ও স্থিতিশীলতার এই একই লক্ষ্য অর্জনে একযোগে কাজ করে যাওয়ার একটি দৃঢ় ভিত্তি আমরা খুজে পাব। – মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আজ আপনাকে আমাদের মধ্যে পেয়ে আমরা কত যে আনন্দিত, তা আবার আমি উন্লেখ করতে চাই। একজন বন্ধুর উপস্থিতি সব সময়ই অত্যন্ত খুশির ব্যাপার ।

আজ আমরা আপনাকে আমাদের পরম বন্ধু বলে গণ্য করি। টা আমি আপনাকে স্বাগত জানাই এবং বাংলাদেশে আপনার অবস্থান আনন্দায়িত হউক, এটাই কামনা করি। মহাতনবৃন্দ,_ ভদ্রমহিলা, ভদ্র মহোদয়গণ, মহিলাগণ, এখন অস্ট্রেলিয়ার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মিসেস…ও অস্ট্রেলিয়ার বন্ধুসুলভ জনগণেরা কষ্ট করে এসে আমার অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য আপনাদের অনুরোধ জানাচ্ছি।

 

Bangabandhu Gurukul
Bangabandhu Gurukul

 

আরও পরুন :

Leave a Comment