[ADINSERTER AMP] [ADINSERTER AMP]

বঙ্গবন্ধুর সরকার – উৎপাদনভিত্তিক অর্থনীতি

উৎপাদনভিত্তিক অর্থনীতি : বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনের আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো উৎপাদনভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন। তাঁর সরকারের অন্যতম লক্ষ্য ছিল কৃষি শিল্পসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষক শ্রমিকসহ সকলের আয় বৃদ্ধি করা। বঙ্গবন্ধুর উৎপাদন বৃদ্ধির এই লক্ষ্যের ধারণা পাওয়া যায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর প্রদত্ত ভাষণের মাধ্যমে।

বঙ্গবন্ধুর সরকার – উৎপাদনভিত্তিক অর্থনীতি:

১৯৭২ সালে ১ মে জাতির উদ্দেশে ভাষণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সংক্রান্ত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সরকারি কর্মচারীদের জন্য কিছু আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমি বিশ্বাস করি, এই পদক্ষেপগুলো আপনাদের বর্তমান দুর্দশার কিছুটা লাঘব করবে। অবশ্য জনগণের ভবিষ্যজীবনের প্রকৃত মান উন্নয়ন এই বেতন বৃদ্ধির ওপর কোন ক্রমেই নির্ভরশীল নয়।

সেটা তখনই সম্ভব হয়ে উঠবে যখন আমাদের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে পুনর্গঠিত এবং কারখানাগুলি পুরো মাত্রায় চালু হবে। আমরা এ পর্যন্ত কোন নতুন কর, খাজনা ধার্য করি নাই আপনারা শুনে অবাক হবেন যে আপনাদের এই বেতন বাড়ানোর জন্য সরকারকে প্রতি বছর অতিরিক্ত ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। কৃষকসহ সর্বস্তরের জনসাধারণকে সুবিধা দেবার জন্য ইতিপূর্বে প্রায় ৭০ কোটি টাকার বকেয়া সুদ খাজনা ও কর মাফ করে দেওয়া হয়েছে।

উৎপাদন বৃদ্ধি করে আমরা এই ঘাটতি পূরণ করতে পারি।” ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতীয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে বেতার-টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন “কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ৮০ ভাগের মালিক আপনারা এখন উৎপাদন বাড়িয়ে সকলে মিলে কাজ করে একথাটাই বিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে হবে বাঙালি জাতির স্বাধীনতার পবিত্র আমানত রক্ষার উপযুক্ত।

১৯৭৪ সালে ১৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বলেন “শ্রমিক ভাইদের কাছে আমার অনুরোধ তোমাদের বারবার বলছি এখনো বলছি প্রোডাকশন বাড়াও। সমাজতন্ত্রের অর্থ এই যে, প্রোডাকশন বাড়াও, ভোগ কর।” ১৯৭৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতীয় দিবস উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন “এই বাংলায় সম্পদের কোন অভাব নেই। কিন্তু তার সদ্ব্যবহারের জন্য সময়ের প্রয়োজন।

আমরা যদি বাংলার এ সম্পদ বাংলার মাটিতে রাখতে পারি, সমাজতান্ত্রিক বিলিবণ্টন ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে পারি এবং সকলে মিলে কঠোর পরিশ্রম করে কলে-কারখানায়, ক্ষেতে-খামারে উৎপাদন বাড়াতে পারি, তবে ইনশাআল্লাহ আমাদের ভাবী বংশধরদের শোষণমুক্ত সুখী ও সমৃদ্ধিশালী এক ভবিষ্যৎ উপহার দিতে পারব।”

এমনিভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে পুলিশ সামরিক বাহিনী, রাজনীতিবিদ, ছাত্রসমাজ প্রত্যেকের কাছে বঙ্গবন্ধু উৎপাদন বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রথম পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে পুলিশ বাহিনীর উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন

“মাঠে, কলকারখানায় সর্বত্র আমাদের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কাজ করতে হবে।”

১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি কুমিল্লার সামরিক একাডেমিতে প্রথম শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে বিদায়ী ক্যাডেটদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, “তোমরা পাকিস্তানের সৈনিক নও, বাংলাদেশের সৈনিক। তোমরা হবে আমাদের জনগণের। তোমরা পেশাদার বাহিনী নও, কেবল সামরিক বাহিনীও নও। দরকার হলে তোমাদের আপন হাতে উৎপাদন করে খেয়ে বাঁচতে হবে।”

বঙ্গবন্ধু ছাত্রদের উদ্দেশে উৎপাদনের কথা বলেছেন। ১৯৭২ সালে ১৯ আগস্ট ১৯৭২ ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনে তিনি বলেন, “গ্রামে গ্রামে বাড়ির পাশে বেগুনগাছ লাগিও, কয়টা মরিচ গাছ লাগিও, কয়টা লাউগাছ, ও কয়টা নারিকেলের চারা লাগিও। বাপ-মারে একটু সাহায্য করো। কয়টা মুরগি পালো। কয়টা হাঁস পালো। জাতীয় সম্পদ বাড়বে। তোমার খরচ তুমি বহন করতে পারবে।

বাবার কাছ থেকে এতটুকু জমি নিয়ে ১০টা লাউগাছ, ৫০টা মরিচ গাছ, কয়টা নারিকেল গাছ লাগিয়ে দাও, দেখবে ২/৩ শত টাকা আয় হয়ে গেছে। তোমরা ঐ টাকা দিয়ে বই কিনতে পারবে । কাজ কর, কঠোর পরিশ্রম করো, না হলে বাঁচতে পারবে না।” শুধু সমাবেশে বা জাতির উদ্দেশে নয়, জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু বারবার উৎপাদনের কথা বলেছেন।

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রথম জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনের দ্বিতীয় বৈঠকে বঙ্গবন্ধু সংবিধান সংশোধনীর ওপর আলোচনায় পাঁচবার Production বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমি বারবার বলেছি আজকে আমাদের আত্মসমালোচনার প্রয়োজন, আজকে আমাদের আত্মসংযমের প্রয়োজন, আজকে আমাদের আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন। তা না হলে দেশকে ভালোবাসা যাবে না, দেশের জন্য কাজ করা যাবে না এবং দেশের উন্নতি করা যাবে না । কলে কারখানায়, ক্ষেতে-খামারে Production বাড়াতে হবে। তা না হলে দেশ বাঁচতে পারে না।” আরেকবার বলেছেন “ক্ষেতে-খামারে কাজ করতে হবে।

কোন জমি পড়ে থাকতে পারবে না। তোমাদের Production বাড়াতে হবে।” বঙ্গবন্ধুর এই উৎপাদনভিত্তিক অর্থনৈতিক দর্শনের বিষয়টি কৃষি এবং শিল্প ক্ষেত্রে প্রয়োগ করানোর মাধ্যমে বাস্তবে ১৯৭৩-৭৪ অর্থ-বছরে কৃষি ক্ষেত্রে আমন ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে শতকরা ২০ ভাগ বেশি এবং আউস ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল ২৩ ভাগ বেশি। শিল্প ক্ষেত্রে ১৯৭৩ ৭৪ সালে কাপড়ের উৎপাদন ১৯৬৯-৭০ সালের তুলনায় শতকরা ২৬.৬ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছিল।

তরল ঔষুধের ক্ষেত্রে উৎপাদন শতকরা ১৮ ভাগ, নৌ-যানের ক্ষেত্রে শতকরা ৮০ ভাগ, ইলেকট্রিক ফ্যানের ক্ষেত্রে শতকরা ৫০ ভাগ, মোটর গাড়ি ট্রাক ও বাস যুক্তকরণের ক্ষেত্রে শতকরা ৩৯৪ ভাগ এবং সাইকেলের ক্ষেত্রে শতকরা ১৭ ভাগ বেড়েছিল। এছাড়া ১৯৬৯-৭০ সালে স্টিল ইন্‌গট উৎপাদনের পরিমাণ ছিল। ৪১,৯৯৩ টন, ১৯৭৩-৭৪ সালে তা হয়েছে ৫৮,২৫৩ টন।

কাঁচা রবারের উৎপাদন ১৯৬৯-৭০ সালে ছিল ১২,০০০ পাউন্ড, ১৯৭৩-৭৪ সালে তা ১৪ গুণ বেড়ে দাঁড়ায় ১,৬৮,০০০ পাউন্ড । ১৯৭২-৭৩ সালে চিনির উৎপাদন ছিল ১৯,০০০ টন। ১৯৭৩ ৭৪ সালে সেই উৎপাদন প্রায় ৫ গুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৮৮,০০০ টন।

১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতীয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে বেতার ও টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন:

“আমরা যদি উৎপাদন বাড়াতে পারি, তাহলে বিনা দ্বিধায় এই আশ্বাস আমি দিতে পারি যে, আমাদের আমদানিনির্ভর অর্থনীতির প্যাটার্ন খুব শীঘ্রই পাল্টে যাবে এবং জিনিসপত্রের দাম কমানো সম্ভব হবে।”

একথা সত্য যে কৃষি বা শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধির দরুন একক প্ৰতি স্থায়ী খরচের অংশ কমে আসার ফলে দ্রব্যের উৎপাদন খরচ কমে আসে এবং দ্রব্যের উৎপাদন খরচ কমলে বাজারে তার বিক্রয় মূল্য (যেটি ক্রেতার ক্রয়মূল্য) কম হয় উপরোক্ত তথ্যে এটি স্পষ্ট যে বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ পদক্ষেপের মাধ্যমে ১৯৭৩-৭৪ সালে অস্বাভাবিক মাত্রায় কৃষি এবং শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এই উৎপাদন বৃদ্ধির ফল হিসেবে (১৯৬৯-৭০ ভিত্তি বছর ধরে) ১৯৭৪-৭৫ সালে যেখানে দ্রব্যমূল্য সূচক ছিল ৪০৭.৫৮, সেখানে ১৯৭৫-৭৬ সালে তা হ্রাস পেয়ে ৩৮০.১৪ তে নেমে আসে। এ থেকে যে বিষয়টি সহজেই অনুধাবন করা যায় – তা হলো বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনের মূল ছিল উৎপাদন ।

Leave a Comment