১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৩ জাতীয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ও টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। ভাষনের বিস্তারিত দেয়া হলো:
আমার প্রিয় দেশবাসী ,
আমি আপনাদের আমার সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি । আগামীকাল ষোলই ডিসেম্বর- আমাদের জাতীয় দিবস। আরও স্পষ্ট কথা “বিজয় দিবস” । লাখো শহীদের রক্তমাখা এই দিন৷ লাখো মা-বোনের অশ্রুভেজা এই দিন। আবার সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর স্বপ্ন ও পরম আকাঙ্খার এই দিন। এই দিন আমরা পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। সোনার বাংলার মানুষ বিদেশী শাসন ও শোষণ থেকে মুক্তি পেয়েছে । এই দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনে বড় পবিত্র, বড় বেশি গৌরব ও আবেগমন্ডিত। এই দিন আমরা শ্রদ্ধা ও শোকের সঙ্গে স্মরণ করি আমাদের শহীদ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ।
১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৩ । জাতীয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ও টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
আবার এই দিন আমরা আনন্দ ও উৎসব করি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাফল্যের জন্য । এই দিন এক যুদ্ধ শেষ হয় আর এক যুদ্ধ শুরু হয়েছে। উনিশ’শ একাত্তর সালের ষোলই ডিসেম্বর আমাদের স্বসংগ্রামের সমাপ্তি।এই একই দিনে আমাদের দেশ গড়ার সংগ্রাম শুরু । স্বাধীনতা সংগ্রামের চাইতেও দেশ গড়া বেশি কঠিন। দেশ গড়ার সংগ্বামে আরো বেশি আত্মত্যাগ, আরও বেশি ধৈর্য, আরও বেশি পরিশ্রম দরকার । স্বাধীনতার সংখামে আরো বেশি সময় লাগার কথা, কিন্তু আমরা যদি একটু কষ্ট করি, একটু বেশি পরিশ্রম করি, সকলেই সৎপথে থেকে সাধ্যমত নিজের দায়িতৃ পালন করি এবং সবচাইতে বড় কথা, সকলে এক্যবদ্ধ থাকি_ তাহলে আমি বিনা দ্বিধায় বলতে পারি ইনশাল্লাহ কয়েক বছরের মধ্যে আমাদের স্বপ্নের বাংলা আবার সোনার বাংলায় পরিণত হবে।
আমার সংগ্রামী বন্ধুরা,
আজ আপনাদের কাছে আমি হাজির হয়েছি বাণী দেওয়ার জন্যে নয়, ভাষণ দেওয়ার জন্য নয়, হাজির হয়েছি মনের দু’টি কথা বলার জন্যে ।শংরামআগে কি নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম? চারদিকে অসংখ্য নরকংকাল, শহীদ বুদ্ধিজীবীর লাশ, বীরাঙ্গনা মা-বোনের আর্তনাদ, হাহাকার, অচল কল-কারখানা, থানা, আইন-আদালত, শূন্য বিধ্বস্ত ব্যাংকে তালা, ট্রেজারী খালি, রেলের চাকা বন্ধ, রাস্তা- বিজ ধ্বংস, বিমান ও জাহাজ একখানাও নেই। যুদ্ধের জন্যে অনেক ক্ষেতে ফসল বোনা. সম্ভব হয়নি, পাট ঘরে ওঠেনি, নৌকা স্টামার লঞ্চ বাস, লরী, ট্রাকের শতকরা সত্তর ভাগ হয় নষ্ট, না হয় অচল। অনেকের হাতে তখন অন্ত্র। তাদের মধ্যে আছে বনু দুক্কৃতিকারী। আমাদের প্রয়োজনীয় সৈন্য ছিল না, পুলিশ ছিল না। জাতীয় সরকারের কাজ চালাবার মত দক্ষ অফিসারও ছিল না।
তখন পাকিস্তানে বন্দী কয়েক লাখ বাঙ্গালী । ভারত থেকে ফিরে আসছে প্রায় এক কোটি বাঙ্গালী উদবান্ত- যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদারদের অত্যাচারে দেশ ত্যাগ করেছিল। তখনই দরকার এদের জন্যে রিলিফ, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা । কুধার্ত বাঙ্গালীকে বাচানোর জন্যে চাই অবিলম্বে খাদ্য ।ঔষধ চাই, কাপড় চাই, চারদিকে এই চাই চাই আর নাই নাই এর মধ্যে আমাদের যাত্রা শুরু । উনিশ’শ একাত্তর থেকে উনিশ”শ তিয়াত্তর সময় হিসেবে মাত্র দু’বছর। এই দু’বছরে আমরা কি পেয়েছি আর কি পাই নাই, আজ তারও খতিয়ান এবং আত্মবিশ্রেষণের দিন।
আমি বড় দাবি করি না। আমরা কোন ভূল করি নাই বা কোন কাজে ত্রুটি করি নাই এমন কথা বলি না। শুধু অনুরোধ করব, আপনাদের চারপাশে পৃথিবীর আরো অনেক দেশের ইতিহাসের দিক তাকিয়ে দেখুন আমেরিকা পৃথিবীর সব চাইতে ধনী দেশ। এই আমৈরকারও স্বাধীনতা লাভের পর দুই দুইটি গৃহযুদ্ধের মোকাবিলা করতে হয়েছে। আজকের অবস্থায় পৌছতে আমেরিকার সময় লেগেছে প্রায় একশ বছর। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রী অর্থনীতি গড়ে তুলতে ত্রিশ বছর প্রত্যেকটি মানুষকে একটানা কষ্ট ও পরিশ্রম করতে হয়েছে। সোভিয়েত বিগ্রবের পর প্রথম পাঁচ বছরে দুর্ভিক্ষে মারা গেছে অসংখ্য লোক।
সমাজতন্ত্রের শত্রু, অসংখ্য লোককে প্রাণদন্ড দিতে হয়েছে। নয়া চীন সমাজতন্ত্রী বিপ্লবের পঁচিশ বছর পরও এখনো খাদ্যে আত্মনির্ভর হয়নি। শ্রমিকদের অল্প মজুরি এবং বছরে দুই প্রস্থ কাপড় নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আমাদের প্রতিবেশী মিত্র রাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে এখনো চলছে গরিবী হটাও আন্দোলন। পৃথিবীর এইসব বড় বড় দেশের পাশাপাশি এই ছোট এবং গরীব বাংলাদেশের কথা বাঙ্গালী হয়ে একবার ভেবে দেখুন। বিগ্রবের পর স্বাধীনতার শক্র হিসেবে যারা অভিযুক্ত হয়েছিল তাদেরও আমরা হত্যা করি না, ক্ষমা করেছি। দুর্ভিক্ষে যাতে মানুষ না মরে তার চেষ্টা করেছি। ভিক্ষা করে হলেও বিদেশ থেকে খাদ্য এনেছি।
বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল খালি ছিল। তবু পরণের কাপড়, রোগের ওঁষধ আমদানীর চেষ্টা করেছি। এক কোটি উদ্বান্তকে ছ’মাসে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গ্রামে গ্রামে যতটা সম্ভব রিলিফ পৌছে দেয়া হয়েছে । সবচাইতে কম সময়ে ভাঙ্গা রাস্তা, রেল, ব্রিজ মেরামত করা হয়েছে। পাকিস্তানীরা যে সারা ব্রীজ ও ভৈরব সেতু ভেঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা খতম করতে চেয়েছিল- তা আবার তৈরি করা হয়েছে । আমি জানি না রক্তাক্ত বিপ্লবের পর পৃথিবীর আর কোন দেশের সঙ্গে সঙ্গে গণতান্ত্রিক শাসন চালু করা হয়েছে কিনা । আমার জানা মতে হয়নি। বাংলাদেশে তা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার বিপ্লবের এক বছরের মধ্যে সংবিধান তৈরি করেছে। নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছে।
ভোট দেওয়ার বয়স একুশের বদলে আঠারো বছর করে ভোটাধিকারের সীমা বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের নিজস্ব বিমান উড়ছে দেশ-বিদেশের আকাশে । নিযুক্ত, স্থল বাহিনী মাতৃভূমির উপর যে কোন হামলা প্রতিরোধে প্রস্তৃত। গড়ে উঠেছে আমাদের নিজস্ব নৌ ও বিমান বাহিনী, থানা ও পুলিশের যে ৭০ ভাগ পাকিস্তানীরা নষ্ট করেছিল এখন আবার তা গড়ে উঠেছে। জাতীয় রক্ষী বাহিনী গঠন করা হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে সরকার এখন আরো নজর দিতে পারবে । একটা প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশকে আবার গড়ে তোলার ব্যাপারে আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। আমাদের সাফল্য যেমন আছে, তেমনই আছে ভূল ভ্রান্তি।
কিন্তু মাত্র দু’বছরে ভুল ভ্রান্তির তুলনায় বাংলাদেশের সাফল্য ও অগ্রগতি আপনারা নিজেরা নিজেদের মনে একবার বিবেচনা করে দেখুন- এই আমার অনুরোধ । এই ভাঙ্গা দেশকে গড়ার কাজে আমি আপনাদের কাছে বিশ-ত্রিশ বছর নয়, মাত্র তিন বছর সময় চেয়েছিলাম । এই তিন বছরে আমি আপনাদের কিছু দিতে পারব না। তবু তিন বছরের দু-বছরই আমাদের চেষ্টা কতটা আন্তরিক ছিল আপনারাই তা বিবেচনা করে দেখবেন। বিপ্লবের পর আপনারা যে বিপুল আস্থা ও সমর্থন আমাকে দিয়েছেন তাতে রেজিম্যান্টেশনের পথে দেশের মানুষের মুখ বন্ধ করে উন্নতির পন্থা আমি গ্রহণ করতে পারতাম।
কিন্তু আমি চেয়েছিলাম আপনাদের সম্মতি নির্দেশ নিয়ে এই দেশের ভাগ্য ফেরাতে । দেশে গণতান্ত্রিক উপায়ে সামজতন্ত্র কায়েম করতে । দেশের সকল ব্যাংক ও বীমা ব্যবসা এখন আপনাদের । কল-কারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠানের ৮০% ভাগ মালিক আপনারা । এখন উৎপাদন বাড়িয়ে সকলে মিলে কাজ করে এ কথাটাই বিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে হবে- বাঙ্গালী জাতি স্বাধীনতার পবিত্র আমানত রক্ষার উপযুক্ত। সে তার গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা ও প্রয়োগে সক্ষম। গণতন্ত্রের অর্থ যা খুশি বলা বা করা নয়। আমাদের দেশে এক শ্রেণীর ‘লোক আছেন, যারা শুধু অসন্তোষ প্রচার করেন। কিন্তু আত্মসমালোচনা করে না। বাংলাদেশকে আমরা যদি প্রকৃতই একটি শান্তি কামী শোষণমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, তাহলে আমাদের প্রত্যেকের আত্ম-সমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি মনোভাব গ্রহণ করা দরকার।
প্রিয় বন্ধুরা,
ষোলই ডিসেম্বরের সঙ্গে আমাদের অনেক ব্যথা-বেদনা, আনন্দ-গৌরব এবং আশা-আকাঙ্থা জড়িত। এইদিন সোহরাওয়াী উদ্যানে প্রায় এক লাখ পাকিস্তানী শত্রু আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে আরো শক্তিশালী শত্রু, এই শক্র হলো অভাব, দরিদ্র, ক্ষুধা, রোগ, অশিক্ষা, বেকার ও দুর্নীতি। এই যুদ্ধের জয় সহজ নয়। অবিরাম এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে এবং একটি সুখী সুন্দর অভাবমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। তবেই হবে আপনাদের সংগ্রাম সফল, আমাদের শেখ মুজিবুরের স্বপ্ন ও সাধনার সমান্তি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একটি বছর ছিল ভাঙ্গা দেশটাকে কোন রকমে খাড়া করার সময়।
এই সময় সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন প্রায় এক কোটি উদ্বান্তর পুনর্বাসন ও দুর্ভিক্ষ ঠেকানোর জন্যে। এই এক বছরে আমরা আমাদের বন্ধু দেশগুলো থেকে যে সাহায্য পেয়েছি- তা আজ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। পাকিস্তানের বিরোধীতা সত্তেও স্বাধীনতা লাভের এক বছরের মধ্যে পৃথিবীর অধিকাংশ সংস্থা এমনকি বিশ্ব ব্যাংকের আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলেরও আমরা সদস্য । তাতেই প্রমাণিত হয় পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ আজ বাংলাদেশের পাশে, স্বাধীনতা লাভের এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশে বড় বড় শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ হয়েছে। ব্যাংক ও বীমা ব্যবসা গরকারের মালিকানায় আনা হয়েছে।
পঁচিশ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা £লে নেয়া হয়েছে। এটাকে আমরা বলতে পারি শান্তিপূর্ণ পথে শমাজতন্ত্রে উত্তরণের চেষ্টা । ফলে বাংলাদেশে ধীর গতিতে হলেও গামাজিক ও অর্থনৈতিক প্যাটার্ন বদলাতে চলেছে। একটা কৃষিনির্ভর মাধ। সামন্ত সামাজিক অবস্থা থেকে সমাজ তান্ত্রিক রাষ্ট্র ও শোষণমুক্ত গমাজ গড়ার চেষ্টায় আমরা নিযুক্ত রয়েছি। তবুও বলব আমরারাজনৈতিক মুক্তি অর্জন করেছি। কিন্ত অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে পারিনি । আমাদের এবারের সংগ্রাম অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের সংগ্রাম । আমি যে সুখি ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি, সংগ্রাম করেছি এবং দুঃখ নির্যাতন বরণ করেছি_ সেই বাংলাদেশ এখনো আমার স্বপ্নে রয়ে গেছে।
গরীব কৃষক ও শ্রমিকের মুখে যতদিন হাসি না ফুটবে, ততদিন আমার মনে শান্তি নাই। এই স্বাধীনতা তখনই আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে, যেদিন বাংলাদেশের কৃষক মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে । তাই আসুন, এই দিনে অভাব, দারিদ্র, রোগ-শোক ও জরার বিরুদ্ধে আমরা এক্যবদ্ধ হয়ে সং ঘোষণা করি। সংগ্রাম ঘোষণা করি চোরাকারবারী, কলোবাজারী, অসৎ ব্যবসায়ী, দূর্ীতিবাজ ও ঘৃষখোদের বিরুদ্ধে । এই যুদ্ধে জয়লাভ করতে না পারলে সোনার বাংলা গড়ার কাজ সফল হবে না। আর সোনার বাংলা গরতে না পারলে ত্রিশ লক্ষ বাঙ্গালী যে স্বাধীনতার জন্যে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, সেই স্বাধীনতাও অর্থহীন হয়ে যাবে।
স্বাধীনতা লাভের পরেও সমাজ দেহের রন্দ্রে রন্দ্রে যে অন্যায়-অবিচার ও শোষণের লীলা খেলা দুর্ণীতির রাজতৃ- তাকে উৎখাত করতেই হবে। আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য চিরদিন আপনাদের সঙ্গে থেকে সংঘাম করেছি। আজও আমি আপনাদের সহযোদ্ধা হিসেবে আপনাদের পাশে আছি। দেশ থেকে সর্বপ্রকার অন্যায়, অবিচার ও শোষণ উচ্ছেদ করার জন্য দরকার হলে আমি আমার জীবন উৎসর্গ করবো ।
বন্ধুগণ,
স্বাধীনতার প্রথম বছরে আমরা অনেক কঠিন কাজ শেষ করার চেষ্টা করেছি।একদিকে ঝড় বন্যার তান্ড, অন্যদিকে জিনিস-পত্রের অভাব। তবু সরকার পূর্ণোদ্যমে রিলিফ ও টেস্ট রিলিফের কাজ চালিয়েছে । বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের কাজ করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ট্রাস্ট ও কল্যাণ তহবিল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, থানা, রাস্তা, ব্রিজ, হাসপাতাল মেরামত করা হয়েছে । সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন করা হয়েছে। মোটামুটি বিচার ব্যবস্থা, আইন শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বন্দর ও প্রোতাশ্রয় থেকে মাইন অপসারণ করা হয়েছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত রেলওয়ে, বিমান বন্দর চালু করা হয়েছে । এক বছরেই একটি সংবিধান দেয়া হয়েছে এবং সেই সংবিধানের আওতায় নতুন সাধারণ
নির্বাচন করা হয়েছে । এই সময়ে বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যয় বরাদ্দ ছিল চারশত কোটি টাকার উপর | ১৯৭২ এর ১৬ ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৩ এর ১৬ ই ডিসেম্বর, এই এক বছরের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য কম নয় । এই সময়টা আমাদের সংবিধান চালু করার কাল । এই সময় ভৈরব সেতু হওয়ার ফলে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটা বড় অসুবিধা দূর হয়েছে। উপমহাদেশের উত্তেজনা দূর করার জন্য দিল্লী চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে।
পাকিস্তানে আটক বাঙ্গালীরা স্বদেশে ফিরতে শুরু করেছেন। ১৪ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৪ হাজারেরও বেশি বাঙ্গালী দেশে ফিরে এসেছে। আমাদের প্রথম পাচসালা পরিকল্পনার কাজ শুরু হয়েছে এবং বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার কাজ চলছে। প্রথম পরিকল্পনাকাল শেষ হলে বাংলাদেশের শুধু অর্থনীতিতে নয় সামাজিক অবস্থাতে একটা বড় পরিবর্তন হবে বলে আশা করি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার মর্যাদা, নিজস্ব আসনটি দখল করেছে। অটোয়ার কমনওয়েলথ এবং আলজিয়ার্স জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ সম্মানিত সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছে। আপনাদের প্রধানমন্ত্রীরূপে আমি যুগোশ্রাভিয়া ও জাপান সফর করেছি।
সেখানও দেখেছি বাংলাদেশের জন্য তাদের আন্তরিক ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা। আলজিয়ার্স জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশকে গ্রহণ করে অধিকাংশ আরব ও আফ্রিকান দেশ তার সার্বভৌমত্রে প্রতি স্বীকৃতি ও সম্মান প্রদর্শন করে। আরব দেশেগুলির মধ্যে মিশর, ইরাক, মরকৌ, তিউনিশিয়া,. বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। সম্প্রতি আরব ইজরাইল যুদ্ধেও বাংলাদেশ আরব দেশগুলির দিকে সংগ্রামী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে আরব দেশগুলির জনসাধারণ বাংলাদেশকে প্রকৃত বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে। বিশ্বের শান্তি ও স্বাধীনতাকামী সকল দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ শুধু নিজেই মুক্তিসংগ্রামের সাফল্য অর্জন করে ক্ষান্ত নয়। বিশ্বের যে কোন নিপীড়িত দেশ ও মুক্তি সংগ্রামীদের পাশে আমরা রয়েছি। দক্ষিণ ভিয়েতনামী বিগ্রবী সরকার ও গিনি বিসাউফে আমরা স্বীকৃতি প্রদান করেছি। বাংলাদেশের রফতানির বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। আমরা যদি উৎপাদন বাড়াতে পারি, তাহলে বিনা দ্বিধায় এই আশ্বাস আমি দিতে পারি যে, আমাদের আমদানী নির্ভর অর্থনীতির প্যাটার্ন খুব শীঘই পাল্টে যাবে এবং জিনিস-পত্রের দাম কমানো সম্ভব হবে ।
প্রিয় দেশবাসী,
মাত্র দুই বছরে আমরা কি করতে পেরেছি না পেরেছি আপনারা বিচার করে দেখবেন। দেশে জিনিস পত্রের অসম্ভব চড়া দামের ফলে আপনাদের যে কষ্ট তা আমি জানি। এই মূল্য বৃদ্ধি শুধু বাংলাদেশেই ঘটেনি, সারা বিশ্বে চলেছে, এই মূল্য বৃদ্ধির হিড়িক। শ্রমিক ভাইদের প্রতি আমার অনুরোধ-মিলে, কারখানায় উৎপাদন বাড়িয়ে শিল্প বিপ্রব সফল করে তুলুন। কৃষক ভাইদের প্রতি আমার অনুরোধ, বাংলাদেশকে খাদ্যে আত্মনির্ভর করে তুলুন । ছাত্র ও যুব শক্তির প্রতি আমার অনুরোধ, নিজেদের প্রকৃত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোল । ব্যবসায়ীদের প্রতি আমার অনুরোধ, অতি মুনাফার লোভ সামলান।
ব্যবসাকেও দেশ সেবার অঙ্গ করে তুলুন। সরকারি কর্মচারীদের প্রতি আমার নির্দেশ- দায়িতু পালনে আরো মন দিন। প্রশাসন থেকে দুর্ণীতি দূর করুন। শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবি সমাজের প্রতি আমার আবেদন- দেশ গড়ার সংগ্রামে আপনারাও কিছুটা অংশ নিন। যারা ধ্বংস করে, ধ্বংসাত্মক চেষ্টা চালায়- তারা শুধু সরকারের শব্র নয়, দেশ ও জনগণের. শক্র | তারা যে সম্পদ হরণ করে- ধ্বংস কর। তা জনগণের সম্পত্তি। কোন পুঁজিপতি বা ব্যক্তিমালিকের সম্পত্তি নয়।
বিপ্লবের নামে যারা উচ্ছৃভখল, স্বেচ্ছাচারে মাতেন_ তারা বিপ্রবের মিত্র নন, জনগণেরও বন্ধু নয়। আপনারাও এই গুপ্ত হত্যা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। আমরা প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ গ্রহণের নীতিতে বিশ্বাসী নই। তাই মুক্তিযুদ্ধের শত্রুতা করে যারা দালাল আইনে অভিযুক্ত ও দন্ডিত হয়েছিলেন, তাদের সদাচরণ ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়েছে। দেশের নাগরিক হিসেবে স্বাভাবিক জীবন যাপনে আবার সুযোগ দেয়া হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি অন্যের প্ররোচনায় যারা বিভ্রান্ত হয়েছেন এবং হিংসার পথ গ্রহণ করেছেন তারা অনুতপ্ত হলে তাদেরও দেশ গড়ার সংগ্রামে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হবে।
বন্ধুগণ, আমরা ইতিহাসের একটি বিরাট সংকটকাল অতিক্রম করেছি। এ সময় দরকার ধৈর্য আত্মত্যাগ ও কঠোর পরিশ্রম, দরকার মনোভাব । বাংলাদেশ তিনশত বছর লুষ্ঠিত ও শোষিত হয়েছে। এর সমাজ ও অর্থনীতিতে হাজারও সমস্যা । রাতারাতি তা দূর করা যাবে না। সোনার বাঙলা গড়ে তুলতে হলে সোনার মানুষ চাই। আর সকলে মিলে কঠোর পরিশ্রম করে আমাদের ভাবী বংশধরদের এক সুখী ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যত উপহার দিতে হবে। আগামীকাল ১৬ই ডিসেম্বর, পবিত্র জাতীয় দিবস। আসুন, আমরা সকলে মিলে দেশ গড়ার সংগ্রামে নিজেদের উৎসর্গ করার শপথ গ্রহণ করি।