১ লা জুলাই ১৯৭৪ । জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

১ লা জুলাই ১৯৭৪ সালের জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণঃ স্পীকার জনাব আব্দুল মালেক উকিলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ প্রথম জাতীয় সংসদের পঞ্চম অধিবেশনের ২০তম বৈঠক শোক প্রস্তাব জনাব স্পীকারঃ”এই সংসদ গভীর দুঃখ ও সমবেদনার সহিত প্রস্তাব করিতেছে যে, জাতীয় সংসদ সদস্য ও গণপ্রজাতন্ত্রি বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও সমাজ কল্যাণ বিভাগীয় মন্ত্রী জনাব জহুর আহমদ চৌধুরীর আকস্মিক মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন বলিষ্ঠ একনিষ্ঠ সমাজসেবী, ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি, শ্রমিক নেতা, অকুতভয় দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামীকে হারাইয়াছে। এই সংসদ তীহার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করিতেছে এবং তীহার শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করিতেছে ।

 

১ লা জুলাই ১৯৭৪ সালের জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ | স্পীকার জনাব আব্দুল মালেক উকিলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত
১ লা জুলাই ১৯৭৪ সালের জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ | স্পীকার জনাব আব্দুল মালেক উকিলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত

 

১ লা জুলাই ১৯৭৪ সালের জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ | স্পীকার জনাব আব্দুল মালেক উকিলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (প্রধানমন্ত্রী)

জনাব স্পীকার, আজ সকাল ৬টা ৪৫ মিনিটে পিজি হাসপাতালে আমাদের সহকর্মী, বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী আলহাজ জহুর আহমদ চৌধুরী ইন্তেকাল করেছেন। দীর্ঘ ৩১ বছর তিনি আমার পাশে পাশে ও সাথে সাথে ছিলেন। আমরা একসাথে, একযোগে এ দেশের মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছি। অনেক কথা মনে পড়ে। ১৬৪৩ সালে তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় । ১৯৪৫ সালে ভন্টগ্রামে যখন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করি, তখন জহুর আহমদ চৌধুরীর মত এম এ আজিজও আমার সাথে ছিলেন। এক দিনের জন্যও তিনি এদেশের জনসাধারণ এবং তাদের ন্যাধ্য দাবীর সংগ্রাম থেকে দূরে সরে দীড়ান নাই। আওয়ামীলীগের জন্ম থেকে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন। তাকে আপনারা এর অন্যতম

প্রতিষ্ঠাতাও বলতে পারেন। অনেকবার কারাবরণ করেছেন তিনি । তিনি প্রায় ৮ বছর কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন। অনেক মামলার আসামীও তাকে হতে হয়েছিল। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দেওয়ার পরে আমরা যখন গ্রেফতার হই, তখন তিনিও গ্রেফতার হন। গ্রেফতারের পরে সিলেট হয়। তার একটা কান বধির ছিল। এ হাউসের অনেকেই হয়ত তা জানেন না, তার উপর সেই সময় যে অত্যাচার করা হয়েছিল, নির্যাতন চালান হয়েছিল, তার ফলেই কানে যে আঘাত লাগে_ তাতে তীর একটা কান বধির হয়ে যায়। ১৯৬৬ সালের আন্দোলনের পরে যে অমানুষিক বধির হয়ে গিয়েছিল।

এমন কোন আন্দোলন নাই, যে আন্দোলনের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন না। তীকে চট্টগ্রামের শ্রমিক আন্দোলনের পিতা বলা হতো। শ্রমিক আন্দোলন কি জিনিস, শ্রমিকের হৃদয় কিভাবে জয় করতে হয়, তা তিনি চট্টগ্রামে দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি খুবই অনাড়ম্বর জীবন- যাপন করতেন এবং সাধারণ মানুষের মত বাস করতেন । সমস্ত দিন-রাত তিনি কৃষকের সাথে, শ্রমিকের সাথে, দুঃখী মানুষের সাথে থাকতেন। তার একটা গুণের ইতিহাস আছে। তিনি যা কিছু উপার্জন করতেন, তা গরীবদের খাইয়ে দিতেন।

আজকাল এটা একটা ফ্যাশন হয়ে গেছে, মন্ত্রী হলেই তার উপর বদনামী এসে যায়। আজ এটা প্রমাণ হয়ে যাক। দেখুক বাংলাদেশের মানুষ যে, মন্ত্রী হলেই তার বদনাম হয় না। আজ জহুর আহমদ চৌধুরীর দিকে চেয়ে দেখুক! তীর চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নাই। তারা খোজ করে দেখুক জহুর আহমদ চৌধুরীর ছেলে-পিলের খাওয়ার পয়সা পর্যন্ত নাই। এটা আজকাল আমাদের দেশের একটা ফ্যাশন যে, আমরা নিজেদের সমালোচনা করে নিজেদের সর্বনাশ করি। দেখুন তার ছেলে-পিলের দিকে তাকিয়ে ।

 

১ লা জুলাই ১৯৭৪ । জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
১ লা জুলাই ১৯৭৪ । জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

 

কি করে যে তারা বাঁচবে, সে চিন্তা করতে আমার ভয় হয়। কারণ স্বাধীনতা সংগ্রামে তার যে কর্মঠ ছেলে ছিল সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আগড়তলায় একটা স্কুল ঘরে বসে এই অঞ্চলের ভার তিনি গ্রহণ করেন এবং সেখানে বসে তিনি তদানীন্তন বাং সরকারের পক্ষ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করেন। কি হয়েছে জানি না। কিছুদিনের মধ্যে অনেক সহকর্মীকে হারাতে হয়েছে। হারাতে হয়েছে হাজার হাজার কর্মী ও নেতাকে । হারাতে হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের হাজার হাজার আওয়ামীলীগ কর্মীকে । স্বাধীনতার পরে অনেকে জীবন দিয়েছে।

অনেকের এমনি সাধারণভাবে মৃত্যু হয়েছেঃ অনেককে হত্যা করা হয়েছে। কিছুদিন আগে প্রতিমন্ত্রী মিসেস বদরুন্নেছা আহমদ ইন্তেকাল করলেন; চট্টগ্রামের লিডার হান্নান সাহেব ইন্তেকাল করলেন। আজ জহুর আহমদ চৌধুরী ইন্তেকাল করলেন। মানুষকে মরতে একদিন হয়-। আজ অবস্থা আমার এই হয়েছে, অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর । আজকাল আমাদের আর কি-ইবা করার আছে, আমাদের কি-ই বা উপায় আছে, আমরা আল্লাহর কাছে মোনাজাত করতে পারি।

মাননীয় স্পীকার, দীর্ঘদিন দেশের জন্য তিনি সংগ্রাম করে চলে গেলেন। বছরের পর বছর কারাবরণ করেছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন। কত যে কটুক্তি শুনতে হয়েছে এই আড়াই বছরের মন্ত্রীত্র জন্য। জহুর আহমদ চৌধুরী কিছুই নিয়ে যাননি। কেউ কিছু নিয়ে যায় না। একদিন সকলকেই মরতে হবে। মৃত্যুটাই স্বাভাবিক। মাননীয় স্পীকার, আজ আপনি শোক প্রস্তাব এনেছেন। অনেক শোক প্রস্তাব এই সংসদে আমাদের পাস করে তীর পরিবারবর্গকে সমবেদনা জন্য। আজকে একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, জহুর আহমদ চৌধুরী আজ সে জিনিস দেখিয়ে গেছেন, যদি আমরা সকলেই তা পালন করে চলতে পারি, তাহলে এদেশের মানুষের মঙ্গল হবে।

তিনি চট্টগ্রামের প্রতিটি দুঃখী মানুষের পাশে এসে দীড়িয়েছেন। সংগ্রামের  সময় অনেকে ঘর থেকে বের হয়ে কথা বলতে সাহস পায়নি। তারা আজকে অনেকেই মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে থাকে । তাতে আমার দুঃখ নেই। সত্য সত্যিই থাকে, মিথ্যা মিথ্যাই হয়। কিছুদিন propaganda করে মানুষকে ধোকা দেওয়া যায়। কিন্তু সেখানে মিথ্যা মিথ্যাই থাকে, সত্য সত্যই থাকে, এ কথা সকলেই জানে ।মাননীয় স্পীকার, আপনার কাছে আমার কিছু বলার নাই। বহু সহকর্মী করিনি।

আর বক্তৃতা করে সমবেদনা জানাবার ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্ত আজ খুব কষ্ট পেয়েছি। একদিনও শান্তি পাননি জহুর আহমদ চৌধুরী । অনেক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। পিজি হাসপাতালের ডাক্তাররা সবাই এবং আরও অনেকেই তার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন । কিন্ত মৃত্যু আল্লাহর হাতে, মৃত্যুকে কেউ রুখতে পারে না। প্রত্যেকটি মানুষেরই যেতে হবে। তাই আজ কবির ভাষায় বলতে চাই, জনাব স্পীকার_

কাঁদিব না আমি
কাঁদিব না আর,
আমার দুঃখের দিন
রহিবে না চিরদিন
দু’দিন কেন তবে
কেঁদে অবসান হবে
দুঃখেও হাসিব আজি
লীলা বিধাতার
কাঁদিব না আমি
কাঁদিব না আর”

মাননীয় স্পীকারঃ সকলের পক্ষ থেকে আপনি যে প্রস্তাব করেছেন_ তা আমি সমর্থন করি এবং আশা করি আপনি সকলকে বলবেন, দুই মিনিট ইতিহাস যদি আমি দিতে যাই তাহলে অনেক সময় লাগবে । আমি আপনার সময় নষ্ট করতে চাই না। আমার মনও অবশ্য ভাল নয় । এই জন্যেই আমি আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করছি।

জনাব স্পীকারঃ মৌলবী জালাল সাহেব, আপনি মোনাজাত পরিচালনা , করবেন। আমি এই সংসদের মাননীয় সদস্য এবং সদস্যাবৃন্দকে অনুরোধ করব দুই মিনিট আমরা দীড়িয়ে বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

( সকলে দীড়িয়ে দুই মিনিট মাগফেরাত কামনা করেন। অতঃপর আলহাজ মৌঃ জালাল আহমদ সাহেব মোনাজাত পরিচালনা করেন )

 

১ লা জুলাই ১৯৭৪ । জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ । Bangabandhu Gurukul

 

আরও পরুন :

Leave a Comment